রবিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৪

যে কামনা নিয়ে

যে কামনা নিয়ে মধুমাছি ফেরে বুকে মোর সেই তৃষা!
খুঁজে মরি রূপ, ছায়াধূপ জুড়ি,
রঙের মাঝারে হেরি রঙডুরি!
পরাগের ঠোঁটে পরিমল-গুঁড়ি,---
হারায়ে ফেলি গো দিশা!

আমি প্রজাপতি---মিঠা মাঠে মাঠে সোঁদালে সর্ষেক্ষেতে;
---রোদের সফরে খুঁজি নাকো ঘর,
বাঁধি নাকো বাসা---কাঁপি থরথর|
অতসী ছুঁড়ির ঠোঁটের উপর
শুড়ির গেলাসে মেতে!

আদিক্ষিণা--দুলালরি বীণা,--পউষ-পরষ-পরশ-হারা!
ফুল-আঙিয়ার আমি ঘুমভাঙা!
পিয়াল চুমিয়া পিলাই গো রাঙা
পিয়ালার মধু,--তুমি রাতজাগা
হোরীর হা রা রা সাড়া!

আমি গো লালিমা,---গোধূলির সীমা,---বাতাসের ‘লালা ফুল
দুই নিমেষের তরে আমি জ্বালি
নীল আকাশের গোলাপি দেয়ালি!
আমি খুশরোজী,---আমি গো খেয়ালি,
চঞ্চল,--চুল্বুল্!

বুকে জ্বলে মোর বাসর দেউটি,--মধু-পরিণয়-রাতি!
তুলিছে ধরণী বিধবা-নয়ন
-- মনের মাঝারে মদনমোহন
মিলননদীর নিধুর কানন
রেখেছে রে মোর পাতি!

দক্ষিণা

প্রিয়ার গালেতে চুমো খেয়ে যায় চকিতে পিয়াল রেণু!---
এ দিক্ষণা,---কাননের বীণা,---বনানীপথের বেণু!
তাই মৃগী আজ মৃগের চোখেতে বুলায়ে নিতেে আঁখি,
বনের কিনারে কপোত আজিকে নেয় কপোতীরে ডাকি!
ঘুঘুর পাখায় ঘুঙুর বাজায় আজিকে আকাশখান,---
আজ দখিনার ফর্দা হাওয়ায় পর্দা মানে না মানা!
শিশিরশীণ্যা বালার কপোলে কুহেলির কারো জাল
উষ্ঞ চুমোর আঘাতে হয়েছে ডালিমের মতো লাল!
দাড়িমের বীজ ফাটিয়া পড়িছে অদরের চারিপাশে
আজ মাধবীর প্রথম উষায়,---দখিনা হাওয়ার শ্বাসে!
মদের পেয়ালা শুকায়ে গেছিল,---উড়ে গিয়েছিল মাছি,
দখিনাপরশে ভরা পেয়ালায় বুদবুদ ওঠে নাচি!
বেয়ালার সুরে বাজিয়া ইঠচে শিরউপশিরাগুলি!
শ্মশানের পথে করোটি হাসিছে,---হেসে খুন হল খুলি!
এস্রাজ বাজে আজ মলয়ের,---চিতার রৌদ্রাতপ
সুরের সুঠামে নিভে যায় যেন,--বৈতরণীর জলে
সুর-জাহ্নবী ফুটে ওঠে আজ মলয়ের কোলাহলে!
আকাশ-শিথানে মধু-পরিণয়,---মিলন-বাসর পাতি
হিমানীশীর্ণ বিধবা তারারা জ্বলে ওঠে রাতারতি!
ফাগুয়ার রগে চাঁদের কপোল চকিতে হয়ে ছে রাঙা!
লালসে কাহার আজ নীলিমার আনন রুধির-লাল,--
নিখিলের গালে গাল পাতে কার কুন্কুম-ভাঙা গাল!
নারাঙ্গি-ফাটা অধর কাহার আকাশ বাতাসে ঝরে!
কাহার বাঁশিটি খুন উথলায়,--পরান উদাস করে!
কাহার পানেতে ছুটিছে উধাও শুিপিয়ালের শাখা!
ঠোঁটে ঠোঁটে ডলে---পরাগ চোঁয়ায় অশোকফুলের ঝাঁকা!
কাহার পরশে পলাশ-বধূর আঁখির কেশরগুলি
মুদে মুদে আসে,---আর বার করে কুঁদে কুঁদে কোলাকুলি!
পাতার বাজারে বাজে হুল্লোড়,--পায়েলার রুণ্ রুণ্,ইকশলয়দের ডাঁশা পেষে কে গো--চোখ করে ঘুম-ঘুম!
এেেসছ দখিনা---ক্ষীরের মাঝারে লুকায়ে কোন এক হীরের ছুরি!---
তহার লাগি তবু ক্ষ্যাপা শাল নিম, তমাল-বকুলে হুড়াহুড়ি!
আমের কুঁড়িতে বাউল বোলতা খুনসুড়ি দিয়ে খসে যায়,
অঘ্রানে যার ঘ্রাণ পেয়েছিল,---পেয়েছিল যারে ‘পোষলারয়
সাতাশে মাঘের বাতাসে তাহার দর বেড়ে গেছে দশগুণ,----
নিছক হাওয়ায় ঝরিয় পড়িছে আজ মউলের কষ গুণ্!
ঠেলে ফেলে দিয়ে নীলমাছি আর প্রজাপতিদের ভিড়
দখিনার মুখে রসের বাগান বিকায়ে দিতেছে ক্ষীর!
এসেছে নাগর,--যানিনীর আজ জাগর রঙিন আঁখি,---
কুয়াশার দিনে কাঁচলি বাঁদিয়া কুচ রেখেিছিল ডাকি,
আজিকে কাঞ্চী যেতেছে খুলিয়া,---মদঘূর্ণনে হায়!
নিশীথের স্বেদ-সীধুধারা আজ ক্ষরিছে দক্ষিণায়!
রূপসী ধরণী বাসকসজ্জা,--রূপালি চাদের তলে
বালুর ফরাশে রাঙা উল্লাসে ঢেউয়ের আগুন জ্বলে!
রোল উতরোল শোনিতে শিরায়,---হিারীর হা রা রা চীত্কার,---
মুখে মুখে মধু,---সুধাসীধু শুধু,---তিত্ কোথা আজ---তিত্ কার!
শীতের বাস্তুভিত ভেঙে আজ এল দক্ষিণা,---মিষ্টি-মধু,
মদেনর হুলে ঢুলে ঢুলে ঢুলে হুঁশ-হারা হল সৃষ্টি-বধূ!

চাঁদিনীতে

বেবিলোন কোথা হারিায়ে গিয়েছে,---মিশর-‘অসুর কুয়াশাকালো;
চাঁদ জেগে আছে আজো অপলক,--মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!
েস যে জানে কত পাথারের কথা,---কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি!
কত যুগ কত যুগান্ত্মরের সে ছিল জ্যোত্স্না, শুক্লাতিথি!
হয়তো সিদিনো আমাদেরি মতো পিলুবারোয়াঁর বাঁশিটি নিয়া
ঘাসের ফরাশে বসিত এমনি দূর পরদেশী প্রিয় ও প্রিয়া!
হয়তো তাহারা আমাদেরি মতো মধু-উত্সবে উঠিত মেতে
চাঁদের আলোয় চাঁদমারী জুড়ে,---সবুজ চরায়,---সবজী ক্সেতে!
হয়তো তাহারা দুপুর-যামিনী বালুর জাজিমে সাগরতীরে
চাঁদের আলোয় দিগদিগন্ত্মে চকোরের মতো চরিত ফিরে!
হয়তো তাহারা মদঘূর্ণনে নাচিত কাঞ্চীবাঁধন খুলে
এম্নি কোন্ এক চাঁদের আলোয়,---মরু-‘ওয়েসিসে তরুর মূল্যে!
বীর যুবাদল শত্রুর সনে বহদিনব্যাপী রণের শেষে
এম্নি কোন্ এক চাঁদিনীবেলায় দাঁড়াত নগরীতোরণে এসে!
কুমারীরর ভিড় আসিত ছুটিয়া, প্রণীয়ীর গ্রীবা জকড়ায়ে নিয়া
হেঁটে যেত তারা জোড়ায় জোড়ায় ছায়াবীথিকার পথটি দিয়া!
তাদের পায়ের আঙুলের ঘায়ে খড়-খড় পাতা উঠিত বাজি,
তাদের শিয়রে দুলিত জ্যোত্স্না-চাঁচর চিকণ পত্ররাজি!
দখিনা উঠিত মর্মরি মধূবনানীর লতা-পল্লব ঘিরে,
চপল মেয়েরা উঠিত হাসিয়া,---‘এর বল্লভ,---এল রে ফিরে!
---তুমি ঢুলে যেতে দশমীর চাঁদ তাহাদের শিরে সারাটি নিশি,
নয়নে তাদের দুলে যেতে তুমি,---চাঁদনী-শরাব,---সরার শিশি|
সেদিনো এম্নি মেঘের আসরে জ্বলেছে পরীর বাসরবাতি,
হয়তো সেদিনো ফুটেছে মোতিয়া,ঝরেছে চন্দ্রমল্লীপাঁতি!
হয়তো সেদিনো নেশাখোর মাছি গুমরিয়া গেছে আযুরবনে,
হয়তো সেদিনো আপেলের ফুর কেঁপেছে আঢুল হাওয়ার সনে
হয়তো সেদিনো এলাচির বন আতারের শিশি দিয়েছে ঢেলে,
হয়তো আলেয়া গেছে ভিজা মাঠে এমনি ভূতুড়ে প্রদীপ জ্বেলে!
হয়তো সেদিনো ডেকেছে পাপিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া ‘সরোর শাখে,
হয়তো সেদিনো পাড়ার নাগরী ফিরেচে এমনি গাগরি কাঁখে!
হয়তো সেদিনো পানসী দুলায়ে গেছে মাঝি বাঁকা ঢেইট বেয়ে,
হয়তো সেদিনো  মেঘের শকুনডানায় গেছিল অাকাশ ছেয়ে!
হয়তো সেদিনো  মানিকজোড়ের মরা পাখিটির ঠিকানা মেগে
অসীম আকাশে ঘুরেছে পাখিনী ছট্ফট্ দুটি পাখার বেগে!
হয়তো সেদিনো খুর্ খুর্ করে খরগোশছানা গিয়েছে ঘুরে
ঘন-মেহগিনি-টার্পিন-তলে---বালির জর্দা বিছানা ফুঁড়ে|
হয়তো সেদিনো জানায়লার নীল জাফরির পাশে একেলা বসি
মরেন হারিণী হেরেছে তোমাে---বনের পারের ডাগর শশী!
শুক্লা একাদশীর নিশীথে মণিহর্মের তোরণে গিয়া
পারাত-দূত পাঠায়ে দিয়েছে প্রিয়ের তরেতে হয়তো প্রিয়া!
অলিভকুঞ্জো হা হা করে হাওয়া কেঁদেছে কাতর যামিনী ভরি!
ঘাসের শাটিনে আলোর ঝালরে ‘মার্টিলপাতা পড়েছে ঝরি!
 উইলোর বন উঠেছে ফঁপায়ে,---‘ইউ তরুশাখা গিয়েছে ভেঙে,
তরুণীর দুধ-ধবধবে বুকে সাপিনীর দাঁত উঠেছে রেঙে!
কোন গ্রীস,--কোন কার্থেজ, রোম, ‘ক্রুবেদেূর-যুগ কোন্---
চাঁদের আলোয় স্মৃতির কবর-সফরে বেড়ায় মন!
জানি না তো কিছু---মনে হয় শুধু এম্নি তুহিন চাঁদের নিচে
কত দিকে দিকে---কত কালে কালে হয়ে গেছে কত কি যে!
কত যে শ্মশান,---মশান কত যে,--কত যে কামনা-পিপাসা-আশা
অস্ত্মাচাঁদের আকামে বেঁধেছে আরব-উপন্যাসের বাসা!

মরুবালু

হাড়ের মালা গলায় গেঁথে---অট্টহাসি হেসে
উল্লাসেতে টলছে তারা,---জ্বলছে তারা খালি!
ঘুরছে তারা লাল মশানে কপাল-কবর ঘেঁষে,
বুকের বোমাবারুদ দিয়ে আকাশটারে জ্বালি
পাঁয়জোরে কাল মহাকালের পাঁচার ফেঁড়ে ফেঁড়ে
মড়ার বুকে চাবুক মেরে ফিরছে তরুর বালি!
সর্বনাশের সঙ্গে তোরা দম্ভে খেলিস পাশা!
হেথায় কোন্ এক সৃষ্টিপ্রাতের সূত্রপাতের ভূমি,
---শিশু মানব গড়েছিল ঐ সাহারায় বাসা;
---সে সব গেছ করেব ঘুমের চুমার ধোঁয়ায় ধূমি!
অটল আকাশ যাচ্ছে জরির ফিতার মতো ফেঁড়া,
জবান তোদের জ্বলছে যমের চিতার গেলাস চুমি!

তোদের সনে ‘ডাইনোসুরের লড়াই হলো কত,--
আলুথালু লুটিয়ে বালুর ডাইনী ছায়ার তলে
আজকে তার ঘুমিয়ে আছে,---চুল্লি শত শত
উঠলো জ্বলে তাদের হাড়ে,---তাদের নাড়ের বলে;
কাঁদছে খাঁ খাঁ কাফন-ঢাকা বালুর চাকার নিচে
মুণ্ড তাদের,---মড়ার কপাল ভৈরবেরি গলে!

তোদের বুকে জাগছে মৃগতৃষ্ঞা,---জাগে ঝড়!
নিস উড়িয়ে শিকারঢ়সোয়ার ধোঁয়ার পিছে পিছে,---
মেঘে মেঘে চড়াও,---বাজের বুক চিরে চক্কর!
নাচতে আছিস আকাশখানার গোখ্রাফণার নিচে,
আরব মিশর চীন ভারতের হাওযায় ঘুরে ঘুরে!
সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি হাপর খিঁচে খিঁচে!

তোদের ভাষা আস্ফালিছে শেখ্ সেনানরি বুকে!
---লাল সাহারার শেরের সোয়ার,---বালুর ঘায়ে ঘেয়ো,
ধমক মেরেে আঁধির বুকে ছুটছে রুকে রুখে!
---তোদের মতন নেইকো তাদের সোদর-সাথী কেহ,
নেইকো তাদের মোদের মতন পিছুডাকের মায়া,
নেইকো তাদের মোদের মতন আর্ত মোহ-স্নেহ!

দানোয়-পাওয়া আগুনদানা,---দারুণ পথের মুখে!
ঘায়েল করি মেঘের বুরুজ বল্লমেরি ঘর,
উড়িয়ে হাজার ‘ক্যারাভেনও তাম্বশিবির বুকে,
উজিয়ে মরীচিকার শিখা---কালফণা জর্জর,
---টলতে আছিস,---দলতে আছিস,---জ্বলতে আছিস ধূ ধূ!
সঙ্গে স্যাঙাত---মসুদ্ ডাকাত,---তাতার যাযাবর!

গাড়তে যাবে যারা তোদের বুকের মাঝে বাসা
হাড্ডি তাদের ফোঁফরা হয়ে ঝুরবে বালুর মাঝে,
এইখানেতে নেইকো দরদ,--,নেইকো ভালোবাসা,
বর্শা লাফায়,---উটের গলার ঘুন্টি শুধু বাজে!
ফুরিয় গেছে আশা যাদের,---জুড়িয়ে গেছে জ্বালা,
আর রে বালুর ‘কারবালাতে, অন্ধকারের ঝাঁঝে!

পিরামিড

---বেলা বেয় যায়
গোধূলির মেঘ-সীমানায়
ধূম্র মৌন সাঁঝে
নিত্য নব দিবসের মৃতু্যঘন্টা বাজে!
শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভষ্মবহ্নি জ্বলে!
পান্থ ম্লান চিতার কবলে
একে একে ডুবে যায় দেশ, জাতি,--সংসার, সমাজ,
কার লাগি হে সমাধি, তুমি একা বসে আছ আজ
কী এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতনÒ
অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন
চকিতে মিলায়ে গেছে-পাও নাই টের!
কোন দিবা অবসানে গৌরবের লক্ষ মুসাফের
দেউটি নিভায়ে গেছে,---চলে গেছে দেউল ত্যজিয়া,
চলে গেছে প্রিয়তম,---চলে গেছে প্রিয়া!
যুগান্ত্মের মণিময় গেহবাস ছাড়ি
চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী,
কবে কোন্ বেলাশেষে হায়
দূর অস্ত্মশেখরের গায়!
তোমারে যায়নি তারা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমর্পিয়া;
সাঁজের নীহারনীল সমুদ্য মথিয়া
মরমে পশেনি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী!
তোরণে আসেনি তব লক্ষ লক্ষ মরণ-সন্ধানী
অশ্রু-ছলছল চোখে,---পাণ|ডুর বদনে!
---কুষ্ঞ যবনিকা করেব ফেলে তারা গেল দূর দ্বারে বাতায়নে
জানো নাই তুমি!
জানে না তো মিশরেরর মূক মরুভূমি
তাদের সন্ধান!
হি নির্বাক পিরামি,---অতীতের স্ত্মব্ধ প্রেত-প্রাণ
অবিচল স্মৃতির মন্দির!
আকাশের পানে চেয়ে আজো তুমি বসে আছো স্থির!
নিষ্পলক যুগ্মভুরু তুলে
চেয়ে আছো অনাগত উদধির কূলে
মেঘ-রক্ত ময়ূখের পানে!
জ্বলিয়া যেতেছে নত্যি নিশি-অবসানে
নূতন ভাস্কার!
বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর
নিবেদিন অরুণের সনে
কোন্ আশা-দূরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গুলি-তাড়নে!
--পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দুদণ্ডের
রুধির-ফোয়ারা
কি এক প্রগল্ভ উষ্ঞ উল্লাসের সাড়া!
থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন!
শতাব্দীর বিরহীর মন
নিটল নিথর
সন্ত্মরি ফিরিয়া মনে গগনের রক্ত-পীত সাগরের পরে!
বালুকার স্ফীত পারাবারে
লোল মৃগতৃষ্ঞিকার দ্বারে
মিশরের অপহৃত অন্ত্মরের লাগি
মৌন ভিক্ষা মাগি!---
--খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার!
মুখরিত প্রাণের সঞ্চার
ধ্বনিত হইবে করেব কলহীন নীলার বেলায়!---
--বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজো তাই বসে আছে
পিরামিড হায়!
-- কত আগন্তুক-কাল,---অতিথি--সভ্যতা
তোমার দুয়ারে এসে কয়ে যায় অসম্বৃত অন্ত্মরের কথা!
তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল!
--তুমি রহ নিরুত্তর,---নির্বেদী,---নিশ্চল!
মৌন, অন্যমনা!
---প্রিয়ার বক্ষের পরের বসি একা নীরবে করিছ তুমি
শবের সাধনা
হে প্রেমিক---স্বতন্হত্র স্বরাট!
---কবে সুপ্ত উত্সবের স্ত্মব্ধ ভাঙা হাট
উঠিবে জাগিয়া!
সস্মিত নয়ন তুলি কবে তব প্রিয়া
আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদ-কৃষ্ঞ, পাণ|ডু, চূর্ণ,
ব্যথিত কপোলে!
মিশর-অলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্বলে!
বসে আছো অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই!
---ওলটিপালটি যুগ-যুগন্ত্মের শ্মশানের ছাই
জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি,--,প্রেমের প্রহরা!
---মোদের জীবনে যবে জাগে পাতা-ঝরা
হেমন্ত্মের বিদায়-কুহেলি,
অরুন্তুদ আঁখি দুটি মেলি
গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান
দুদিনের তরে শুধু,---নবোত্ফুল্লা মাধবীর গান
মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে
নিমেষে চকিতে!
---অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে
ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে!

মিশর

‘মমীর দেহ বালুর তিমির যাদূর ঘরে লীন,--
‘স্ফীন্ক্স-দানবীর অরাল ঠোঁটের আলাপ আজি চুপ!
ঝাঁ ঝাঁ মরুরু ‘লুয়ের  ‘ফুঁয়ে হচ্ছে বিলীন-ক্ষীণ
মিশর দেশের কাফন পাহাড়---পিরামিডের স্তূপ!

নিভে গেছে ‘ঈশিশেররি বেদীর থেকে ধূমা,
জুড়িয়ে গেছে লক্লকে সেই রক্তজিভার চুমা!
এদ্দিনেতে ফুরিয়ে গেছে কুমীরপূজার ঘটা,
দুলছে মরুমশান-শিরে মহাকালের জটা!
ঘুমন্ত্মদের কানে কানে কয় সে, ---‘ঘুমা,---ঘুমা!

ঘুমিয়ে গেছে বালুর তলে ফ্যারাও,---ফ্যারাও ছেলে,---
তাদের বুকে যাচ্ছে আকাশ বর্শা ঠেলে ঠেলে!
হাওয়ার সেতার দেয় ফুঁপিয়ে ‘ মেম্ননেরি বুক,
যুবে গেছে মিশররবি,---বিরাট ‘বেলের ভুখ
জিহ্বা দিয়ে জঠর দিয়ে গেছে তোমায় জ্বেলে!

পিরামিডের পাশাপাশি লালচে বালুর কাছে
স্থবির মরণ-ঘুমের ঘোরে মিশর শুয়ে আছে!
সোনার কাঠি নেই কি তাহার? জাগবে নাকি আর!
মৃতু্য,---সে কি শেষের কথা?---শেষ কি শবাধার!
সবাই কি গো ঢালাই হবে চিতার কালির ছাঁচে!

নীলার ঘোলা জলের দোলায় লাফায় কালো সাপ|
কুমীরগুলোর খুলির খিলান,---করাত-দাঁতের খাপ
উর্ধ্বমুখে রৌদ্র পোহায়;---ঘুমপাড়ানির ঘুম
হানছে আঘাত,---আকাশবাতাস হচ্ছে যেন গুম!
ঘুমের থেকে উপচে পড়ে মৃত্যের মনস্ত্মাপ!

নীলা, নীলা,--ধুক্ধুকিয়ে মিশরকবর-পারে
রইলে জেগে বোবাবুকের বিকল হাহাকারে!
লাল আলেয়ায় খেয়া ভাসায় ১রামেসেসের দেশ!
অতীত অভিশাপের নিশা এলিয়ে এলোকেশ
নিভিয়ে দেছে দেউটি তোমার দেউল-কিনারে!

কলসী কোলে নীলনদেতে যেতেছে ঐ নারী,
ঐ পথেতে চলতে আছে নিগ্রো সারি সারি;
ইয়ান্কী ঐ,--ঐ য়ুরোপী,--চীনে-তাতার-মুর
তোমার বুকের পাঁজর দলে টলতেছে হুড়ুমুড়,--
ফেনিয়ে তুলে খুন্খারাবি,---খেলাপ,---খবরদারী!

দিনের আলো ঝিমিয়ে গেল,---আকাশে ঐ চাঁদ
-- চপল হাওয়ায় কাঁকন কাঁদায় নীলনদেরি বাঁধ!
মিশর-ছুড়ি গাইছে মিঠা শুঁড়িখানার সুরে
বালুর খাতে, প্রিয়ের সাথে,--খেজুরবনে দূরে!
আফ্রিকা এই,---এই যে মিশর,---যাদূর এ যে ফাঁদ!

‘ওয়েসিসের ঠাণ|ডা ছায়ায় চৈতিচাঁদের তলে
মিশরবালার বাঁশির গলা কিসের কথা বলে|
চলছে বালুর চড়াই ভেঙে উটের পরে উট,--
এই যে মিশর,--আফ্রিকার এই কুহকপাখাপুট!
---কি এক মোহ এই হাওয়াতে,---এই দরিয়ার জলে!

শীতল পিরামিডের মাথা,--‘গীজের মূরতি
অন্কবিহীন যুগসমাধির মূক মমতা মথি
আবার যেন তাকায় অদূর উদয়গিরির পানে!
‘মেম্ননের ঐ কণ্ঠ ভরে চারণ-বীণার গানে!
আবার জাগে ঝাণ্ডাঝালর,--জ্যান্ত আলোর জ্যোতি!

শ্মশান

কুহেলির হিমশয্যা অপসারি ধীরে
রূপময়ী তন্বী মাধবীরে
ধরণী বরিয়অ লয় বারে -বারে-বারে!
--আমাদের অশ্রুর পাথারে
ফুটে ওঠে সচকিতে উত্সবের হাসি,
অপরূপ বিলাসের বাঁশি!
ভগ্ন-প্রতিমারে মোরা জীবনের বেদীতটে আরবার গড়ি,
ওফনাময় সুরাপাত্র ধরি
ভুলে যাই বিষের আস্বাদ!
মোহময় যৌবনের সাধ
আতপ্ত করিয়া তোলে স্থবিরের তুহিন- অধর!
চির-মৃতু্যচর
হে মৌন শ্মশান,
ধূম -অবগুন্ঠনের অন্ধকারে আবরি বয়ান
হেরিতেছ কিসের স্বপন!
ক্ষনে ক্ষণে রক্তবহ্নি করি নিবাপন
স্ত্মব্ধ করি রাখিতেছ বিরহীর ক্রন্দনের ধ্বনি!
তব মুখ-পানে চেয়ে কবে বৈতরণী
হয়ে গেছে কলহীন!
 বক্ষে তব হিম হয়ে আছে কত উগ্রশিখা চিতা
হে অনাদি পিতা!
ভষ্মগর্ভে, --মরণের অকূল শিয়রে
জন্নযুগ দিতেছ প্রহরা,--
কবে বসুন্ধরা
মৃতু্যগাঢ় মদিরার শেষ পাত্রখানি
তুলে দেবে হস্ত্মে তব, -কবে লবে টানি
কন্কাল- অঙ্গুলি তুলি শ্যামা ধরণীরে
শ্নাশান -তিমিরন,
লোলুপ নয়ন মেলি হেরিবে তাহার বিবসনা শোভা
দিব্য মনোলোভা!
কোটি কোটি চিতা -ফণা দিয়া
রূপসীর অঙ্গ আলিঙ্গিয়া
শুষে নেবে সৌন্দর্যের তামরস-মধু!
এবমুধা-বধূ
আপনারে ডারি দেবে উরসে তোমার!
ধ্বক্ ধ্বক্  দারুণ তৃষ্ঞার
রসনা মেলিয়া--
অপেক্ষায় জেগে আছে শ্নাশানের হিয়া!
আরোকে-আধারে
অগণন চিতার দুয়ারে
যেতেছে সে ছুটে,
তৃপ্তিহীন তিক্ত বক্ষপুটে
আনিতেছে নব=মৃদ্যু-পথিকেরে ডাকি,
তুলিতেছে রক্ত-ধূম্র -আখি!
--নিরাশার দীঘ শ্বাস শুধু
বৈতরণীমরু ঘেরি জ্বলে যায় ধূ ধূ,
আসে না প্রেয়সী!
--নিদ্রাহীন শশী,
আকাশের অনাদি তারকা,
রহিয়াছে জেগে তার সনে ;
শ্নাশানের হিম বাতায়নে
শত শত প্রেতবধূ দিয়ে যায় দেখা,-
তবু সে যে পড়ে আছে একা,
বিমনা-বিরহী!
বক্ষে তার কত লক্ষ সভ্যতার স্মৃতি গেছে দহি,
কত শৌর্য -সাম্রাজ্যের সীমা
প্রেম-পুণ্য -পূজার গরিমা
অকলন্ক সৌন্দর্যের  বিভা
গৌরবের দিবা!
--তবু তার মেটে নাই তৃষা;
বিচ্ছেদের নিশা
অহো তার হয় নাই শেষ!
অশ্রান্ত্ম অঙ্গুলি সে যে করিছে নির্দেশ
অবনীর পক্ববিম্ব অ:রের পর !
পাতাঝরা হেমন্ত্মের স্বর
করে দেয় সচকিত তারে
মিানী-পাথারে
কুয়াশাপুরীর মৌ ন জালায়ন তুলে
চেয়ে থাকা অাঁধারে অকূলে
সুদূরের পানে|
বৈতরণীখেয়াঘাটে মরণ--সন্ধানে
এল কি রে জাহ্নবীর শেষ ঊর্মিধারা!
অপার শ্মশান জুড়ি জ্বলে লক্ষ চিতাবহ্নি, --কামনা-সাহারা!

বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৪

ডাহুকী

মালঞ্চে পুষ্পিতা লতা অবনতমুখী,--
নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী
বিজন-তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে
বনচ্ছায়া-অন্ত্মরালে তরল তিমিরে
--আকাশে মন্থর মেঘ, নিরালা দুপুর!
--নিস্ত্মব্ধ পল্লীর পথে কুহকের সুর
বাজিয়া উঠিছে আজ ক্ষণে ক্ষণে ক্ষণে!
সে কোন্ পিপাসা কোন্ ব্যাথা তার মনে
হারায়েছে wপ্রয়ারে কি ?--অসীম আকাশে
ঘুরেছে অনন্ত্ম কাল রীচিকা -আশে?
বাঞ্ছিত দেয়নি দেখা নিমেষের তরে!--
কবে কোন্ রুক্ষ কাল- বৈশাখীর ঝড়ে
ভেঙে গেছে নীড়, গেছে নিরুদ্দেশে ভাসি!
--নিঝুম বনের তটে বিমনা উদাসী
গেয়ে যায়; সুপ্ত পল্লী-তাটিনীর তীরে!--
ডাহুকীর প্রতিধ্বনি-ব্যথা যায় ফিরে|
পল্লবে নিস্ত্মব্ধ পিক,-- নীরব পাপিয়া,
গাহে একা নিদ্রাহারা বিরহিণী হিয়া!
আকাশে গোধূলি এল,-- দিক্ হল স্নান,
ফুরায়না তবু হায় হুতাশীর গান!
স্ত্মিমিত পল্লীরে তটে কাঁদে বারবার,
কোন্ যেন সুনিভূত রহস্যের দ্বার
উন্নক্ত হল না আর কোন্ সে গোপন
নিল না হৃদয়ে তুলি তার নিবেদন|

পতিতা

আগার তাজার বিভীষিকাভরা, --জীবন মরণময়!
সমাজের বুকে অভিশাপ সে যে,--সে যে ব্যাধি, --সে যে ক্ষয়;
প্রেমের পসরা ভেঙে ফেলে দিয়ে ছলনার কারাগার
রচিয়াছে সে যে,--দিনের আলোয় রুদ্ধ করেছে দ্বার!
সূর্যাকিরণ চকিতে নিভায়ে সাজিয়াছে নিশাচর,
কালনাগিনীর ফণার মতন নাচে সে বুকের পর!
চক্ষে তাজার কালকূট ঝরে,--বিষপস্কিল শ্বাস,
সারাটি জীবন মরীচিকা তার,--প্রহসন-পরিহাস!
ছোঁয়াচে তাহার স্লান হয়ে যায় শশীতারকার শিখা,
আলোকের পারে নেমে আসে তারে আঁধারের যবনিকা!
সে যে মন্বন্ত্মর,--মূতু্যর দ্যত,--অপঘাত,--মহামারী,--
মানুষ তবু সে,--তার চেয়ে বড়ো,--সে যে নারী, সে যে নারী!

নিখিল আমার ভাই

নিখিল আমার ভাই,
- -কীটের বুকেতে যেই ব্যাথা জাগে আমি সে বেদনা পাই;
যে প্রাণ গুমরি কাঁদিছে নিরালা শুনি যেন তার ধ্বনি,
কোন ফণী যেন আকাশ বাতাসে তোলেবিষ-গরজনি!
কি যেন যাতনা মাটির বুকেতে অনিবার ওঠে রণি,
আমার শস্য-র্স্বণপসরা নিমেষে হয় যে ছাই!
--সবার বুকের বেদনো আমার, নিখিল আমার ভাই|

আকাশ হতেছে কালো,
কাহাদের যেন ছায়াপাতে হায়, নিভে যায় রাঙা আলো!
বাতায়রে মোর জড়ায়ে কাতের বেদনার নাগপাশ,
বক্ষে আমার জাগিছে কাদের নিরাশা ,গ্লানিমা, ত্রাস,
--তাদের ব্যথার কুহেলি-পাথারে আকাশ হতেছে কালো|

লভিয়াছে বুঝি ঠাঁই
আমার চোখের অশ্রু পুঞ্জে নিখিলের বোন-ভাই|
আমার গানেতে জাগিছে তাদের বেদনা-পীড়ার দান,
আমার প্রাণেতে জাগিছে তাদের নিপীড়িত ভগবান,
আমার হৃদয়- যূপেতে তাহারা করিছে রক্তস্নান,
আমার মনের চিতানলে জ্বলে লটিায়ে যেতেছে ছাই!
আমার চোখের অশ্রুপুঞ্জে লভিয়াছে তারা ঠাঁই|

বিবেকানন্দ

জয়,--তরুণের জয়!
জয় পুরোহিত আহিতাগ্নিক,--জয়,---জয় চিণ্ময়!
স্পর্শে তোমার নিশা টুটেছিল,---উষা উঠেছিল জেগে
পূর্ব তোরণে, বাংলা-আকাশে,---অরুণ-রঙিন মেঘে;
আলোকে তোমার ভারত, এশিয়া,--জগত্ রেঙে|

হে যুবক মুসাফের,
স্থবিরের বুকে ধ্বনিলে শঙ্খ জাগরণপর্বের!
জিঞ্জির-বাঁধা ভীত চকিতেরে অভয় দানিলে আসি,
সুপ্তের বুকে বাজালে তোমার বিষাণ হে সন্ন্যাসী,
রুক্ষের বুকে বাজালে তোমার কালীয়-দমন বাঁশি!

আসিলে সব্যসাচী,
কোদণ্ডে তব নব উল্লাসে নাচিয়া উঠিল প্রাচী!
টন্কারে তব দিকে দিকে শুধু রণিয়া উঠিল জয়,
ডন্কা তোমার উীঠল বাজিয়া মাভৈঃ মন্ত্রময়;
শন্কাহরণ ওহে সৈনিক,---নাহিকো তোমার ক্ষয়!

তৃতীয় নয়ন তব
ম্লান বাসানার মনসিজ নাশি জ্বালাইত উত্সব!
কলুষ-পাতকে, ধূর্জটি, তব পিনাক উঠিত রুখে,
হানিতে আঘাতত দিবানিশি তুমি ক্লেদ-কামনার বুকে,
অসুর-আলয়ে শিব-সন্ন্যাসী বেড়াতে শঙ্খ ফুঁকে!

কৃষ্ঞচক্র সম
ক্লৈব্যের হুদে এসেছিলে তুমি ওগো পুরুষোত্তম,
এসেছিলে তুমি ভিখারীর দেশে ভিখারীর ধন মাগি
নেমেছিলে তুমি বাউলের দলে,---হে তরুণ বৈরাগী!
মর্মে তোমার বাজিত বেদনা আর্ত জীবের লাগি|

হে প্রেমিক মহাজন,
তোমার পানেতে তাকাইল কোটি দরিদ্র-নারায়ণ;
অনাথের বেশে ভগবান এসে তোমার তোরণতলে
বারবার যবে কেঁদে কেঁদে গেল কাতর আঁখির জলে,
অর্পিলে তব প্রীতি-উপায়ন প্রাণের কুসুমদলে!

কোথা পাপী? তাপী কোথা?
----ওােগ ধ্যানী, তুমি পতিত-পাবন যজ্ঞে সাজিলে হোতা!
শিব-সুন্দর-সত্যের লাগি শুরু করে দিলে হোম,
কোটি পঞ্চমা আতুরের তবে কাঁপায়ে তুলিলে ব্যোম,
মন্ত্রে তোমার বাজিল বিপুল শান্ত্মি স্বস্ত্মি ওঁ!

সোনার মুকুট ভেঙে
ললাট তোমার কাঁটার মুকুটে রাখিলে সাধক রেঙে!
স্বার্থ লালসা পাসরি ধরিলে আত্মাহুতির ডালি,
যজ্ঞের যূপে বুকের রুধির অনিবার দিলে ঢালি,
বিভাতি তোমার তাই তো অটুট রহিল অংশুমালী!

দরিয়ার দেশে নদী!
---বোধিসত্ত্বের আলয়ে তুমি গো নবীন শ্যামল ররোধি!
হিংসার রণে আসিলে পথিক প্রেম-খঞ্জর হাতে,
আসিলে করুণা-প্রদীপ হস্ত্মে হিংসার অমারামে,
ব্যাধি মন্বন্ত্মরে এলে তুমি সুধা-জলধির সংঘাতে!

মহামারী ক্রন্দন
ঘুচাইলে তুমি শীতল পরশে,---ওগো সুকোমল চন্দন!
বজ্র-কঠোর, কুসুম-মৃদুল,---আসিলে লোকোত্তর;
হানিলে কুলিশ কখনো,---ঢালিলে নির্মল নির্ঝর,
নাশিলে পাতক,--পাতকীরে তুমি অর্পিলে নির্ভর|

চক্র গদার সাথে
এনেছিলে তুমি শঙ্খ পদ্ম,---হে ঋষি, তোমার হাতে,
এনেছিলে তুমি ঝড় বিদু্যত্,---পেয়েছিলে তুমি সাম,
এনেছিলে তুমি রণ-বিপ্লব,---শান্ত্মি-কুসুম-দাম;
মাভৈঃ শঙ্খে জাগিছে তোমার নর-নারায়ণ-নাম!

জয়,--তরুণের জয়|
আত্মাহুতির রক্ত কখনো আঁধারে হয় না লয়!
তাপসের হাড় বজ্রের মতো বেজে উঠে বারবার!নাহি রে মরণে বিনাশ,--শ্মশানে নসাহw তার সংহার,
দেশে দেশে তার বীণা বাজে---বাজে কালে কালে ঝন্কার!

হিন্দু-মুসলমান
মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে---পুণ্য ভারতপুরে
পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নামাজের সুরে সুরে!
আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে,
মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনিটি গগনে গগনে বাজে;
জপে ঈদগাতে তসবী ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে,
সন্ধ্যা-উষায় বেদবাণী যায় মিশে কোরানের স্বরে;
সন্ন্যাসী আর পীর
মিলে গেছে হেথা,--মিশে গেছে হেথা মসজিদ, মন্দির!

কে বলে হিন্দু বসিয়া রয়েছে একাকী ভারত জাঁকি?
---মুসলমানের হস্ত্মে হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখী,
আরব শিমর তাতার তুর্কি ইরানের চেয়ে মোরা
ওগো ভারতের মোসলেমদল,--তোমাদের বুক-জোড়া!
ইন্দ্রপ্রস্থ ভেঙেছি আমরা,---আর্যাবর্ত ভাঙি
গড়েছি নিwখল নতুন ভারত নতুন স্বপনে রাঙি!
নবীন প্রাণে সাড়া
আকাশে তুলিয়া ছুটিছে মুক্ত যুক্তবেণীর ধারা!


রুমের চেয়রে ভারত তোমার আপন,---তোমার প্রাণ!
---হেথায় তোমার ধর্ম অর্থ,--হেথায় তোমার ত্রাণ;
হেথায় তোমার আসান ভাই গো, হোথায় তোমার আশা;
যুগ যুগ ধরি এই ধূলিতলে বাঁধিয়াছ  তুমি বাসা,
গড়িয়াছ ভাষা কল্পে কল্পে দরিয়ার তীরে বসি,
চক্ষে তোমার ভারতের আলো,---ভারতের রবি, শশী,
হে ভাই মুসলমান,
তোমাদের তরে কোল পেতে আছে ভারতে ভগবান!

এ ভারতভূমি নহেকো তোমার, নহেকো আমার একা,
হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ,---মুসলমানের রেখা;
---হিন্দু মনীষা জেগেছে এখানে আদিম উষার ক্ষণে,
ইন্দ্রদু্যম্নে উজ্জয়িনীতে মথুরা বৃন্দাবনে!
পাটলীপুত্র শ্রাবস্ত্মী কাশী কোলশ তক্ষশীলা
অজন্ত্মা আর নালন্দা তার রটিছে কীর্তিলীলা!
---ভারতী কমলাসীনা
কালের বুকেতে বাজায় তাহার নবপ্রতিভার বীণা!

এই ভারতের তখতে চড়িয়া শাহানশাহার দল
স্বপ্নের মণি-প্রদীপে গিয়েছে উজলি আকাশতল!
---গিয়েছে তাহারা কল্পলোকের মুক্তার মালা গাঁথি,
পরশে তাদের জেগেছে আরব্য-উপন্যাসের রাতি!
যমুনাজলের পুরানো বাঁশিতে বেজেছে নবীন সুর!
নতুন প্রেমের রাগে
তাজমহলের তরুণিমা আজো ঊষার অরুণে জাগে!

জেগেছে হেথায় আকবরী আইন,---কালের নিকষ কোলে
বারবার যার উজল সোনার পরশ উঠিছে জ্বলে!
সেলিম,--শাজাহাঁ,--চোখের জলেতে একশা করিয়া তারা
গড়েছে মিনার মহলা স্ত্মম্ভ কবর ও শাহদারা!
---ছড়ায়ে রয়েছে মোগল ভারত,---কোটি সমাধির স্তূপ
তাকায়ে রূেছে তন্দ্রাবিহীন,--অপলক অপরূপ|
--যেন মায়াবীর তুড়ি
স্বপনের ঘোরে স্ত্মব্ধ করিয়া রেখেছে কনকপুরী!

মোতিমহলের অযুত রাত্রি,--লকজ্ষ দীপের ভাতি
আজিও বুকের মেহেরাবে যেন জ্বালায়ে যেতেছে বাতি!
---আজিও অযুত বেগম-বাঁদীর শষ্পশয্যা ঘিরে
অতীত রাতের চঞ্চল চোখ চকিতে যেতেছে ফিরে!
দিকে দিকে আজো বেজে ওঠে কোন গজলঢ়ইলাহী গান!
পথ-হারা কোন ফকিরের তানে কেঁদে ওঠে সারা প্রাণ!
--নিখিল ভারতময়
মুসলমানের স্বপন-প্রেমের গরিমা জাগিয়া রয়!

এসেছিল যারা উষর মরুগিরিপথ বেয়ে,
একদা যাদের শিবিরে-সৈন্যে ভারত গেছিল ছেয়ে,
আজিকে তাহারা পড়শি মোদের, --মোদের বহিন-ভাই;
---আমাদের বুকে বক্স তাদের,---আমাদের কোলে ঠাঁই|
‘কাফের ‘যবন টুটিয়া গিয়াছে,---ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা,
মোসলেম বিনা ভারত বিফল,--বিফল হিন্দু বিনা;
---মহামৈত্রীর গান
বাজিছে আকাশে নব ভারতে গরিমায় গরীয়াস!

দেশবন্ধু

বাংলার অঙ্গনেতে বাজায়েছ নটেশের রঙ্গমল্লী গাঁথা
অশান্ত্ম সন্ত্মান ওগো,--বিপ্লবিনী পদ্মা ছিল তব নদী--মাতা|
কালবৈশাখীর দোলা অনিবার দুলাইত রক্তপুঞ্চ তব
উত্তাল উর্মির তালে,---বক্ষে তব লক্ষ কোটি পন্নগ-উত্সব
উদ্যত ফণার নৃত্যে আস্ফালিত ধূর্জটির কণ্ঠ-নাগ জিনি,
ত্র্যম্বক-পিনাকে তব শন্কাকুল ছিল সদা শত্রু অক্ষৌহিণী|
স্পর্শে তব পুরোহিত, ক্লেদে প্রাণ নিমেষেতে উঠিত সঞ্চারি,
এসেছিলে বিষ্ঞুচক্র মর্মন্তুদ,--ক্লৈব্যের সংহারী|
ভেঙেছিলে বাঙালির সর্বনাশী সুষুপ্তির ঘোর,
ভেঙেছিলে ধূলিক্লিষ্ট শন্কিতের শৃঙ্খলের ডোর,
ভেঙেছিলে বিলাসের সুরাভাণ্ড তীব্র দর্পে,---বৈরাগের রাগে,
দাঁড়ালে সন্নাসী যবে প্রাচীমঞ্চে--পৃথ্বী-পুরোভাগে|
নবীন শাক্যের বেশে, কটাক্ষেতে কাম্য পরিহরি
ভাসিয়া চলিলে তুমি ভারতের ভাব-গঙ্গোত্তরী
আর্ত অস্পৃশ্যের তবে, পৃথিবীর পঞ্চমার লাগি;
বাদলের মন্দ্র সম মন্ত্র তব দিকে দিকে তুলিলে বৈরাগী|
এনেছিলে সঙ্গে করি অবিশ্রাম প্লাবনের দুন্দুভিনিনাদ,
শান্ত্মিপ্রিয় মুমূষূ©র শ্মশানেতে এনেছিলে আহব-সংবাদ,
গাণ্ডীবের টন্কারেতে মুহুমূ©হু বলেছিলে,---‘আছি, আমি আছি!
কল্পশেষে ভারতের কুরুক্ষেত্রে আসিয়াছি নব সব্যসাচী|
ছিলে তুমি দধীচির অস্থিময় বাসবের দম্ভোলির সম,
অলঙ্ঘ্য, অজেয়, ওগো লোকোত্তর, পুরষোত্তম|
অহিংসার তপোবনে তুমি ছিলে চক্রবতী© ক্ষত্রিয়ের সাজে,---
অক্ষয় কবচধারী শালপ্রাংশু রক্ষকের বেশে|
ফেরুকুল-সন্কুলিত উঞ্ছবৃত্তি ভিক্ষুকের দেশে
ছিলে তুমি সিংহশিশু, যোজনান্ত্ম বিহরি একাকী
স্ত্মব্ধ শিলাসন্ধিতলে ঘন ঘন গর্জনের প্রতিদ্ধনি মাখি|
ছিলে তুমি নীরবতা-নিষে্্পষিত নির্জীবের নিদ্রিত শিয়রে
উণ্মত্ত ঝটিকা সম, বহ্নিমান বিপ্লবের ঘোরে;
শক্তিশেল অপঘাতে দেশবক্ষে রোমাঞ্চিত বেদানার ধইন
ঘুচাতে আসিয়াছিলে মৃতু্যঞ্জয়ী বিশল্যকরণী|
ছিলে তুমি ভারতে অমাময় স্পন্দহীন বিহ্বল শ্মশানে
শব-সাধকের বেশে,--সঞ্জীবনী অমৃত সন্ধানে|
রণনে রঞ্চনে তব হে বাউল, মন্ত্রমুগ্ধ ভারত, ভারতী;
কলাবিত্ সম হায় তুমি শুধু দগ্ধ হলে দেশ-অধিপতি|
বিধিবশে দূরাগত বন্ধু আজ, ভেঙে গেছে বসুধা-নিমোক,
অন্ধকার দিবাভাগ বাজে তাই কাজরীর শ্লোক|
মল্লারে কাঁদিছে আজ বিমানের বৃন্ত্মহারা মেঘছত্রীদল,
গিরিতটে, ভূমিগর্ভ ছায়াচ্ছন্ন,--উচ্ছ্বাসউচ্ছল|
যৌবনের জলরঙ্গ এসেছিল ঘনস্বনে দরিয়ার দেশে,
তৃষ্ঞাপাংশু অধরেতে এসেছিল ভোগবতী ধারার আশ্লেষে|
অর্চনার হোমকুণ্ডে হবি সম প্রাণবিন্দু বারংবার ঢালি,
বামদেবতার পদে অকাতরে দিয়ে গেল মেধ্য হিয়া ডালি|
গৌরকান্ত্মি শন্করের অম্বিকার বেদীতলে একা
চুপে চুপে রেখে এল পুঞ্জীভূত রক্তস্রোত-রেখা|

সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৪

সিন্ধু

বুকে তব সুর-পরী বিরহঢ়বিধূর
                গেয়ে যায়, হে জলধি, মায়ার মুকুর!
কোন্ দূর আকশের ময়ূর-নীলিমা
                তোমারে উতলা করে! বালুচর সীমা
উল্লঙ্ঘি তুলিছ তাই শিরোপা তোমার,---
                উচ্ছৃঙ্খল অট্টহাসি,---তরঙ্গের বাঁকা তলোয়ার!
গলে মৃগতৃষ্ঞাুবিষ, মারীর আগল
                তোমার সুরার স্পর্শে আশেক-পাগল!
উদ্যত উর্মির বুকে অরৃপের ছবি
                নিত্যকাল বwহছক হে মরমিয়া কবি
হেদুন্দুভি দুর্জয়ের, দূরন্ত্ম অগাধ!
                পেয়েছি শক্তির তৃপ্তি বিজয়ের স্বাদ
                তোমার উলঙ্গনীল তরঙ্গের গানে!
কালে কালে দেশে দেশে মানুষ-সন্ত্মানে
                তুমি শিখায়েছ বন্ধু দুর্মদ-দূরাশা!
আমাদের বুকে তুমি জাগালে পিপাসা
                দুশ্চর তটের লাগি --সুদূরের তরে|
রহস্যের মায়াসৌধ বক্ষের উপরে
                ধরেছ দুস্ত্মর কাল;--তুচ্ছ অভিলাষ,
দুদিনের আশা, শান্ত্মি, আকাঙ্খা, উল্লাস,
পলকে দৈন্য -জ্বালা-জয়-পরাজয়,
                ত্রাস-ব্যথাজাসি-অশ্রু-তপস্যা-সঞ্চয়,--
পিনাকশিখায় তব হ,ল ছারখার|
ইচ্ছার বাড়বকুণ্ডে,উগ্র পিপাসার
                ধূ ধূ ধূ ধ বেদীতটে আপনারে দিতেছ আহুতি|
মোরক্ষুধা-দেবতারে তুমি করো স্তুতি!
                নিত্য নব বাসনার হলাহলে রাঙি
‘পারীয়ার প্রাণ লয়ে আছি মোরা জাগি
                বসুধার বাঞ্ছাকূপে, উঞ্ছের অঙ্গনে!
নিমেষের খেদ-হর্ষ-বিষাদের সনে
                বীভত্‌স খঞ্জের মতো করি মাতামাতি!
                চুরমার হয়ে যায় বেলোয়ারি বাতি!
ক্ষুরধার আকা•ক্ষার অগ্নি দিয়া চিতা
                গড়ি তবুবারবার--বারবার ধুতুরার তিতা
নিঃস্ব নীল ওষ্ঠ তুলি নিতেছি চুমিয়া!
                -মোর বক্ষকপোতের কপোতিনী প্রিয়া
কোথা কবে উড়ে গেছে,--পড়ে আছে আহা
                নষ্ট নীড়,--ঝরা পাতা, --পূবালির হাহা!
কাঁদে বুকে মরা নদী,-শীতের কুয়াশা!
                ওহে সিন্ধু, আসিয়াছি আমি সর্বনাশা
ভুখারী ভিখারী একা, আসন্ন- বিবশ!
                --চাহি না পলার মালা, শুক্তির কলস,
মুক্তাতোরণের তট মীনকুমারীর,
চাহি নানিতল নীড় বারুণীরাণীর!
                মোর ক্ষুধা উগ্র আরো, অলঙ্ঘ্য অপার!
একদিন কুকুরের মতো হাহাকার
                তুলেছিনু ফোঁটা ফোঁটা রুধিরের লাগি!
একদিন মুখখানা উঠেছিল রাঙি
                ক্লেদবসাপিন্ড চুমি রিক্ত বাসনার!
মোরে ঘিরে কেঁদেছিল কুহেলি আঁধার,---
                শ্মশানফেরেুর পাল,---শিশিরের নিশা,
                আলেয়ার ভিজা মাঠে ভুলেছিনু দিশা|
আমার হ্রদয়পীঠে মোর ভগবান
                বেদনার পিরামিড পাহাড়প্রমাণ
গেঁথে গেছে গরলের পাত্র চুমুকিয়া;
রুদ্র তরবার তব উঠুক নাচিয়া
                উচ্ছিষ্টের কলেজায়, অশিব -স্বপনে,
হে জলধি, শব্দভেদী উগ্র আস্ফালনে!
--পূজাথালা হাতে লয়ে আসিয়াচে কত পান্থ, কত পথবালা
সহর্য়ে সমুধ্যতীরে; বুকে যার বিষ-মাখা শায়কের জ্বালা
                সে শুধু এসেছে বন্ধু চুপে চুপে একা|
                অন্ধকারে একবার দুজনার দেখা!
                                বৈশাখের বেলাতটে সমুদ্রের স্বর,---
                অনন্ত্ম, অভঙ্গ, আনন্দসুন্দর!
                                তারপর, দূরপথে অভিযান বাহি

                চলে যাব জীবনের জয়গান গাহি|

কবি

ভ্রমরীর মতো চুপে সৃজনের ছায়াধূপে ঘুরে মরে মন
                আমি নিদালির আঁখি, নেশাখোর চোখের স্বপন!
                নিরালায় সুর সাধি,---বাঁধি মোর মানসীর বেণী,
                মানুষ দেখেনি মোরে কোনোদিন,---আমারে চেনেনি!
কোনো ভিড় কোনোদিন দাঁড়ায়নি মোর চারিপাশে,---
শুধায়নি কেহ কভু---‘আসে কি রে,---সে কি আসে---আসে!
আসেনি সে ভরাহাটে--খেয়াঘাটে---পৃথিভীর পসরার মাঝে,
পাটনী দেখেনি তারে কোনো দিন, মাঝি তারে ডাকেনিকো সাঁঝে!
পারাপার করেনি সে মণিরত্ম-বেসাতির সিন্ধুর সীমানা,---
চেনা চেনা মুখ সবি,--সে যে শুধু সুদূর--অজানা!

                করবীকুড়ির পানে চোখ তার সারাদিন চেয়ে আছে চুপে,
                রূপ-সাগরের মাঝে কোন্ দূর গোধূলির সে যে আছে ডুবে!
                সে যেন ঘাসের বুকে, ঝিল্মিল্ শিশিরের জলে;
                খুঁজে তারে পাওয়া যাবে এলোমেলো বেদিয়ার দলে,
                বাবলার ফুলে ফুলে ওড়ে তার প্রজাপতি-পাখা,
                ননীর আঙুলে তার কেঁপে ওেেঠ কচি নোনা-শাখা!

হেমন্ত্মের হিম মাঠে, আকাশের আবছায়া ফুঁড়ে
বকবধূটির মতো কুয়াশায় শাদা ডানা যায় তার উড়ে!
হয়তো শুনেছ তারে,---তার সুর,----দুপুরঢ়আকাশে
ঝরাপাতা-ভরা মরা দরিয়ার পাশে
বেজেছে ঘুঘুর মুখে,---জল-ডাহুকীর বুকে পউষনিশায়
হলুদ পাতার ভিড়ে শিরশিরে পূবালি হাওয়ায়!

                হয়তো দেখেছ তারে ভূতুড়ে দীপের চোখে মাঝরাতে দেয়ালের পরে
                নিভে-যাওয়া প্রদীপের ধূসর ধোঁয়ায় তার সূর যেন ঝরে!
                শুক্লা একাদশী রাতে বিধবার বিছানায় যেই জ্যোত্‌স্না ভাসে
                তারি বুকে চুপে চুপে কবি আসে,---সুর তার আসে!
                উস্খুস্ এলোচুলে ভরে আছে কিশোরীর নগ্ন মুখখানি,--
                তারি পাশে সুর ভাসে,---অলখিতে উড়ে যায় কবির উড়ানি!

বালুঘড়িটির বুকে ঝিরিঝিরি ঝিরিঝিরি গান যবে বাজে
রাতবিরেতের মাঠে হাঁটে সে যে আলসে,---অকাজে!
ঘুম-কুমারীর মুখে চুমো খায় যখন আকাশ,
যখন ঘুমায়ে থাকে টুনটুনি,---মধূমাছি,---মাস,
হাওযার কাতর শ্বাস থেমে যায় আমলকি ঝাড়ে,
বাঁকা চাঁদ ডুবে যায় বাদলের মঘের আঁধাে,
তেঁতুলের শাখে-শাখে বাদুড়ের কালো ডানা ভাসে,
মনের হরিণী তার ঘুরে মরে হাহাকারে বনের বাতাসে|

                জোনাকির মতো সে যে দূরে দূরে যায় উড়ে উড়ে--
                আপনার মুখ দেখে ফেরে সে যে নদীর মুকুরে!
                জ্বলে ওঠে আলেয়ার মতো তার লাল আঁখিখানি|
                আঁধারে ভাসায় খেয়া সে কোন পাষাণী!

জানে না তো কি যে চায়,---কবে হায় কি গেছে হারায়ে!
চোখ বুজে খোঁজে একা, --হাতড়ায় আঙুল বাড়ায়ে
কারে আহা|--কাঁদে হা হা পুবের বাতাস,
শ্মশানসবের বুকে জাগে এক পিপাসার শ্বাস!
তারি লাগি মুখ তোলে কোন্ মৃতা,---হিম চিতা জ্বেলে দেয় শিখা,

তার মাঝে যায় দহি বিরহীর ছায়া-পুত্তলিকা!

ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল

ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,---
ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার,--রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,
চুল যার শাঙনের মেঘ,---আর আখি গোধূলির মতো গোলাপি রঙিন,
আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে,---স্বপ্নে---কত দিন|
মোর জানালার পাশে তারে দেখিয়াছি রাতের দুপুরে,---
তখন শকুনবধূ যেতেছিল শ্মশানের পানে উড়ে উড়ে|

মেঘের বুরুজ ভেঙে অস্তচাঁদ দিয়েছিল উঁকি,
সে কোন্ বালিকা একা অন্ত্মঃপুরে এল অধোমুখী!
পাথারের পারে মোর প্রাসারেদ আঙিনার পরে
দাঁড়াল সে,---বাসাররাত্রির বধূ,---মোর তরে, যেন মোর তরে!
তখন নিভিয়া গেছে মণিদীপ,---চাঁদ শুধু খেলে লুকোচুরি,---
ঘুমের শিয়রে শুধু ফুটিতেছে-ঝরিতেছে ফুলঝুরি,---স্বপনের কুঁড়ি!

অলস আয়ুল হাওযা জানালায় থেকে থেকে ফুঁপায় উদাসী!
কাতর নয়ন কার হাহাকারে চাঁদিনীতে জাগে গো উপাসী!
কিঙ্খাবে-গালিচাখাটে রাজবধূ-ঝিয়ারীর বেশ
কভু সে দেয়নি দেখা,---মোর তোরণের তলে দাঁড়াল সে এসে!
দাঁড়াল সে হেঁটমুখে,--চোখ তার ভরে গেছে নীল অশ্রুজলে!
মীনকুমারীর মতো কোন্ দূর সিন্ধুর অতলে

ঘুরেছে সে মোর লাগি!---উড়েছে সে অসীমের সীমা!
অশ্রুর অঙ্গার তার নিটোল ননীর গাল,--নরম লালিমা
জ্বলে গেছে,--নগ্ন হাত,--নাই শাঁখা,---হারায়েছে রুলি,
এলোমেলো কারো চুলে খসে গেছে খোঁপা তার,---বেণী গেছে খুলি!
সাপিনীর মতো বাঁকা আযুলে ফুটেছে তার কন্কালের রূপ,
ভেঙেছে নাকের ডাঁশা,--হিম স্ত্মন,--হিম রোমকূপ!

আমি দেখিয়াছি তারে, ক্ষুধিত প্রেতের মতো চুমিয়াছি আমি
তারি পেয়ালায় হায়! পৃথিবীর উষা ছেড়ে আষিয়াছি নামি
কান্ত্মারে;---ঘুরেম ভিড়ে বাঁধিয়াছি দেউলিয়া বাউলের ঘর,
আমি দেখিয়াছি ছায়া,--শুনিয়াছি একাকিনী কুহকীর স্বর!
বুকে মো, কোলে মোর--কন্কালের কাঁকালের চুমা!
---গঙ্গার তরঙ্গ কানে গায়,---‘ঘুমা---ঘুমা!

ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,---
ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার,--রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,
চুল যার শাঙনের মেঘ,---আর আখি গোধূলির মতো গোলাপি রঙিন;

আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে,---স্বপ্নে---কত দিন|

ছায়া-প্রিয়া

দুপুররাদে ও কার আওয়াজ!
                গান কে গাহে,--গান না!
কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে
                নিঝুম ঝিঁঝিঁর বুকের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
                এ কার তবে কান্না!
গান কে গাহে,--গান না!

শার্শি ঘরের উঠছে বেজে,
                উঠছে কেঁপে পর্দা!
বাতাস আজি ঘুমায় আছে
                জল-ডাহুকের বিেকর আছে;
এ কোন বাঁশি শার্শি বাজায়
                এ কোন হাওয়া ফর্দা
 দেয় কাঁপিয়ে পর্দা!

নূপুর কাহার বাজল রে ঐ!
                কাঁকন কাহার কাঁদল!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
                দুধের শিশুর বুকের কাছে;
ঘরে আমার ছায়া-প্রিয়া
মায়ার মিলন ফাঁদল!
কাঁকন যে তার কাঁদল!

খস্খসাল শাড়ি কাহার!
                উস্খুসাল চুল গো!
পুরে বধূ ঘুমিয়ে আছে
                দুধের শিশুর বুকের কা্েযছ;
জুলপি কাহার উঠলো দুলে!
                --দুলল কাহার দুল গো!
উসখুসাল চুল গো!

আজকে রাতে কে ঐ এল
কালের সাগর সাঁতরি!
জীবন-ভোরেরসঙ্গিনী সেই,--
মাঠে ঘাটে আজকে সে নেই!
কোন তিয়াষায় এল রে হায়
মরণপারের যাত্রী!
--কালের সাগর সাঁত্রি!
কাঁদাছে পাখি পউষনিশির
                তেপান্ত্মরের বক্ষে!
ওর বিধবা বুকের মাঝে
                যেন কেগা কার কাঁদন বাজে!
ঘুম নিহি আজ চাঁদের চোখে,
                নিদ্ নাহি মোর চক্ষে!
তেপান্ত্মরের বক্ষে!

এল আমার ছায়া-প্রিয়া,
                কিশোরবেলার সই গো!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
                দুধের শিশুর বুকের কাছে;
মনের মধু,--মনোরমা,---
                কই গো সে মোর--কই গো!
কিশোরবেলার সই গো!

ও কার আওয়াজ হাওয়ায় বাজে!
                গান কে গাহে, গান না!
কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে
                বনের ছায়ায়,---মাঠের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
                এ কার তবে কান্না!

গান কে গাহে,---গান না!

রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৪

অস্তচাঁদে

ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ--কèান্ত্ম শেষপ্রহরের শষী!
--অঘোর ঘুমের ঘোরে  ঢলে কালো নদী,-ঢেউয়ের কলসী,
নিঝ্ঝুম বিছানার পরে
মেঘ- বৌর খোপাখসা জ্যোত্স্নাফুল চুপে চুপে ঝরে,-
চেয়ে থাকি চোখ তুলে -- যেন মোর পলাতক প্রিয়া
মেঘের ঘোমটা তুলে প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া!
সে যেন দেখেছে মোরে জন্নে জন্নে ফিরে ফিরে ফিরে
মাঠে ঘাটেএকা একা,-বুনোহাঁস জোনাকির ভিরে!
দুশ্চল দেউলে কোন্ --কোন্ যক্ষ- প্রাসাদের তটে,
দূর উর--ব্যাবিলোন্ --মিশরের মরুভূ -সষ্কটে,
কোথা পিরামিডেতলে,- ঈসিসের বেদিকার মূলে,
কেউটের মতো নীলা যেউখানে ফণা তুলে উঠিয়াছে ফুলে,
কোন মন-ভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালী সনে
আমারে দেখেছে জ্যোত্স্না,-চোর চোখ- অলস নয়নে|

আমারে দেখেছে যে সে আসীরীয় সম্রাটের বেশে
প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে,-
হাতে তার হাত, পায়ে তার হাতিয়ার রাখি
কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আwঁখ!
ভোরগেলাসের সুরা,--তহুরা, -- করেছি মোরা চুপে চুেপ পান,
চকোরজুড়ির মতো কুহরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান!
পেয়ালায়-পায়েলায় সেই নিশি হয়নি উতলা,
নী নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা|
নটিরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমে রাজবধূ,-
চুরি করে পিয়েছনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!
সম্রাঞ্জীর নিদয় অাঁখির দর্প বিদ্রপ ভুলিয়া
কৃষ্ঞাতিথি- চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া
লভেছিনু উল্লাস,-উতরোল!--আজ পড়ে মনে
সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্নজন্নান্ত্মের,-রাতের নির্জনে!
আমি ছিনু ‘ক্রবেদূর্ কোন্ দূর ‘প্রভেন্স্- প্রান্ত্মরে!
--দেউলিয়া পায়দল,-- অগোচর মনচোর-মানিনীতরে
সারেঙের সুর মোর এমনি উদাস রাত্রে উঠিত ঝন্কারি!
আঙুরলতা ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়ি
ঘুঘুর পাখনা মেলি মোর পানে আসিল পিয়ারা;
মেঘের ময়ূরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা !
--‘অলিভ্ পাতার ফাঁকে চুনচোখে চেয়েছিল চাঁদ,
ুমিলননিশার শেষে--বৃশ্চিক, গোক্ষুরাফণা,-- বিষের বিস্বাদ!

স্পেইনের ‘সিয়েরায় ছিনু আমি দসু্য--অশ্বরোহী,-- নির্মম-কুতৃন্ত্ম-কাল,--তবু কি যে কাতর--বিরহী!
কোন্ রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন!
অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন!
তখন রতনশেজে গিয়েছিল নিভে মধুরাতি,
নীল জানালার পাশে--ভাঙা হাটে--চাঁদের বেসাতি!
চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!
ব্যাধের মতন আম টেনেছিনু বুকে
কোন ভীরু কপোতরি উডু উডু ডানা!
--কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ--আলোর মোহানা!

বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,
গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!
‘ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে এমনই রূপালি রাতে
কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!
অপরাজিতার ঝাড়ে--নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুুঝি!--
মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি!
তারি লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া,
তাহারি লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু,--ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!
তাহারি নধর অধর নিঙাড়ি উথলিল বুকে মধ্র,
জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!
মনে পড়ে কি তা!--চাঁদ জানে যাহা,--জানে যা কৃষ্ঞাতিথির শশী,
বুকের আগুনে খুন চড়ে,--মুখ চুন হয়ে যায় একেলা বসি!

আলেয়া

প্রান্ত্মরের পারে তব তিমিরের খেয়া
নীরবে াডেতেছে দুলে নিদালি আলেয়া!
---হেথা, গৃহ-বাতায়নে নিভে গেছে প্রদীপের শিখা,
ঘোমটায় আঁখি ঘেরি রাত্রি-কুমারিকা
চুপে চুপে চলিতেছে বনপথ ধরি!
আকাশের বুকে বুকে কাহাদের মেঘের গাগরী
ডুবে যায় ধীরে ধীরে আঁধার-সাগরে!
ঢুলু-ঢুলু তারকার নয়নের পরে
নিশি নেমে আসে গাঢ়,--স্বপন-সন্কুল!
শেহালায় ঢাকা শ্যাম বালুকার কূল
বনমরালীর সাথে ঘুমায়েছে করেব!
বেণুবনশাখে কোন্ পেঁচকের রবে
চমকিছে নিরালা যামিনী!
পাতাল-নিলয় ছাড়ি কে নাগ-কামিনী
আঁকাবাঁকা গিরিপথে চলিয়াছে চিত্রা অভিসারিকার প্রায়|
শ্মশান-শস্যায়
নেভ-নেভ কোন্ চিতা-স্ফুলিঙ্গেরে ঘিরে
ক্ষুধিত আঁধার আসি জামিতেছে ধীরে!
নিদ্রার দেউলমূলে চোখ দুমি মুদে
স্বপ্নে বুদবুদে
বিলসিছে যবে ক্লান্ত্ম ঘুমন্ত্মের দল----
হে অনল,---উণ্মুখ, চঞ্চল
উন্নমিত আঁখি দুমি মেলি
সন্ত্মরি চলিছ তুমি রাত্রির কুহেলি
কোনদ্ দূর কামনার পানে!
ঝলমল দিবা অবসানে
বধির আঁধারে
কান্ত্মারের দ্বারে
এক কি তব মৌন নিবেদন!
---দিকভ্রন্ত্ম,---দরদী,--উণ্মান!
পল্লীপসারিণী যবে পণ্যরত্ম হেঁকে গেছে চলে,
তোরম পিঙ্গল আঁখি ওঠেনি তো জ্বলে
আকাঙ্খার উলঙৃ্গ উল্লাসে!
---জনতায়,--নগরীর তোরণের পাশে,
অন্ত্মঃপুরিকার বুকে--মণিসৌধ-সোপানের তীরে,
মরকত-উন্দনীল-অয়স্কান্ত্ম খনির তিমিরে
যাওনি তো কভু তুমি পায়ে-সন্ধানে!
ভাঙা হাটে,---ভিজা মাঠে,---মরণের পানে শীত প্রেতপুরে
একা একা মরিতেছে ঘুরে!
না জানি কি পিপাসার ক্ষোভে!
আমাদের ব্যর্থতায়,---আমাদের সকাতর কামনায় লোভে
মাগিতে আসনি তুমি নিমেষের ঠাঁই!
---অন্ধকার জলাভূমি,---কন্কালের ছাই,
পল্লীকান্ত্মারের ছায়া,---তেপান্ত্মর পথের বিস্ময়
নিশীথের দীর্ঘশ্বাসময়
করিয়াছে বিমনা তোমারে!
রাত্রি-পারারে
ফিরিতেছ বারম্বার একাকী বিচরি!
হেমন্ত্মের হিম পথ ধরি,
পউষ অাকাশতলে দহি দহি দহি
---ছুটতেতছবিহ্বল বিরহী
কত শত যুগজণ্ম বহি!
কারে কবে বেসেছিলে ভালো
হে ফকির,---আলেয়ার আলো!
কোন দূর অস্ত্মমিত যৌবনের স্মৃতি বিমথিয়া
চিত্তে তব জাগিতেছে কবোকার প্রিয়া!
সে কোন্ রাত্রি হিমে হয়ে গেছে হারা!
নিয়েছে ভুলায়ে তারে মায়াবী ও নিশিমরু,---
আঁধার-সাহারা!
আজো তব লোহিত-কপোলে
চুম্বন-শোণিমা তার উীঠতেছে জ্বলে
অনল-ব্যাথায়!
----চলে যায়,---মিলনের লগ্ন চলে যায়!
দিকে দিকে ধূমাবাহু যায় তব ছুটি
অন্ধকারে লুটি লুটি লুটি!
ছলাময় আকাশের নিচে
লক্ষ প্রেতবধূদের পিছে
ছুটিয়া চলিছে তব প্রেম-পিপাসার
অগ্নি-অভিসার!
বহ্নি-ফেনা নিঙাড়িয়া পাত্র ভরি ভরি,
অনন্ত্ম অঙ্গার দিয়া হৃদয়ের পাণ্ডুলিপি গড়ি,
উষার বাতাস ভুলি,---পলাতকা রাত্রির পিছনে
যুগ যুগ ছুটিতেছ কার অন্বেষণে!

একদিন খুঁজেছিনু যারে

একদিন খুঁজেছিনু যারে
বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,
মালতীলতার বনে,---কদমের তলে,
নিঝুম ঘুমের ঘাটে,---কেয়াফূল,---শেফালির দলে!
---যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে
হেমন্ত্মের হিম ঘাসে যাহারে খুঁজিয়াছিনু ঝরো ঝরো
কামিনীর ব্যথার শিয়রে,

যারে লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ্ চীনা তাতারের দলে,
আর্ত কোলাহলে
তুলিয়অছি দিকে দিকে ব্যথা বিঘ্ন ভয়,---
আজ মনে হয়
পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনোদিন জলে নাই শিখা!
--শুধু শেষ-নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা,
শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা
দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া!
মাঠে ঘাটে কিশোরীর কাঁকনের রাগিণীতে তার সুর
শোনে নাই কেউ,
গাগরীর কোলে তার উথলিয়া ওঠে নাই আমাদের
গাঙিনীর ঢেউ!
নামে নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকাপথে চুপে চুপে
ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি!
মনে হয় শুধু আমি,---আর শুধু তুমি
আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা
রাত্রির নির্জনযাত্রী তারকার কানে-কানে কত কাল
কহিয়াছি আধো-আধো কথা|
--আজ বুঝি ভুলে গেছ প্রিয়া!
পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের-হিয়া
একদিন ছিল তব গোধূলির সহচর,---ভুলে গেছ তুমি!
এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি
আর মোর বুকে বাজে শুধু খেদ,---শুধু অবসাদ!
মহুয়ার,--ধুতুরার স্বাদ
জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা ফোঁটা ধরি
দূরন্ত্ম শোনিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি!
মসজেদ-সরাই-শরাব
ফুরায় না তৃষা মোর,---জুড়ায় না কলেজার তাপ!
দিকে দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ,--আলেয়ার শিখা!
পদে পদে নাচে ফণা,---
পথে পথে কালো যবনিকা!
কাতর ক্রন্দন,---
কামানার কবর-বন্ধন!
কাফনের অভিযান,--অঙ্গার-সমাধি!
মৃতু্যর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে কাঁদি!
মর্মর্ কেঁদে ওঠে ঝরাপতা-ভরা ভোররাতের পবন,---
আধো আঁধারের দেশে
বারবার আসে ভেসে
কার সুর!---
কোন্ সুদূরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মতো মোর
কেঁদে মরে মন!

চলছি উধাও

চলছি উধাও, বল্গাহারা,-ঝড়ের বেগে ছুটি !
শিকল কে সে বাঁধছে পায়ে !
কোন্ সে ডাকাত ধরেছে চেপে টুটি !
-আঁধার আলোর সাগর-শেষে
প্রেতের মতো আসছে ভেসে|
আমার দেহের ছায়ার মতো, জরিয়ে আছে মনের সনে,
যেদিন আমি জেগেছিলাম, সে-ও জেগেছে আমার মনে !
আমার মনের অন্ধকপারে
ত্রিশূলমূলে,---দেউলদ্বারে
কাটিয়েছে সে দূরন্ত্ম কাল ব্যর্থ-পূজার পুষ্প ঢেলে!
স্বপন তাহার সফল হবে আময় পেলে,---আমায় পেলে!
রাত্রি-দিবার জোয়ারস্রোপতে
নোঙর-ছেঁড়া হৃদয় হতে
জেগেছে সে হালের নাবিক,---
চোখের ধাঁধায়,---ঝড়ের ঝাঁঝে,---
মনের মাঝে,---মনের মাঝে!
আমার চুমোর অন্বেষণে
প্রিয়ার মতো আমার মনে
অন্কহারা কাল ঘুরেছে কাতর দুটি নয়ন তুলে,
চোখের পাতা ভিজিয়ে তাহার আমার অশ্রু-পাথার-কূলে!
ভিজে মাঠের অন্ধকারে কেঁদেছে মোর সাথে
হাতটি রেখে হাতে!
দেকিনি তার মুখখানি তো,---
পাইনি তারে টের,
জানিনি হায় আমার বুকে আশেক,--অসীমের
জেগে আছে জনম-ভোরের সূতিকাগার থেকে!
কত নতুন শরাবশালায় নাবনু একে একে!
শরাবখানার দিলপিয়ালায় মাতি
কাটিয়ে দিলাম কত খুশির রাতি!
জীবন-বীণার তারে তারে আগুন--ছড়ি টানি
গুলজারিয়া এল গেল কত গানের রাণী,--
নাসপাতি-গাল গালে রাখি কানে কানে করলে কানাকানি
শরাব-নেশায়া রাঙিেং দিল আঁখি!
---ফুলের ফাগে বেহুঁশ হলি নাকি!
হঠাত্ কখন স্বপন-ফানুস কোথায় গেল উড়ে|
---জীবন-মরু-মরীচিকার পিছে ঘুরে ঘুরে
ঘায়েল হয়ে ফিরল আমার বুকের ক্যারাভেন,--
আকাশ-চরা শ্যেন!
মরু-ঝড়ের হাহাকারে মৃগতৃষার লাগি
প্রাণ যে তাহার রইল তবু জাগি
ইবলিসেরি সঙ্গে তাহার লড়াই হল শুরু!
দরাজ বুকে দিল্ যে উড়ু-উড়ু!
---ধূসর ধূ ধূ দিগন্ত্মরে হারিয়ে-যাওয়া নার্গিসেরি শোভা
থরে থরে উঠলো ফটে রঙিন-মেনালোভা!
অলকি আশার,---ধুর-দূরাশার দুয়ার ভাঙার তবে
যৌবন মোর উঠল নেচে রক্তমুঠি,---ঝড়ের ঝুঁটির পরে!
পিছে ফেলে টিকে থাকার পাটক-কারাগর,
ভেঙে শিকল,--ধ্বসিয়ে ফাঁড়ির দ্বার
চলল সে যে ছুটে!
শৃঙ্খল কে বাঁধল তাহার পায়ে,---
চুলের ঝুঁটি ধরল কে তার মুঠে|
বর্শা আমার উঠ্ল ক্ষেপে রুখে!
দুশমন কে পথের সুমুখে|
---কোথায় কে বা!
এ কোন মায়া!
মোহ এমন কার!
বুকে আমার বাঘের মতো গর্জাল হুন্কার!
মনের মাঝের পিছুডাকা উঠল বুঝি হেঁকে,---
সে কোন্ সুদূর তাহার আলোর থেকে
মাথার পরের খাঁ খাঁ মেঘের পাথারপুরী ছেড়ে
নেমে এল রাত্রিদিবার যাত্রা-পথে কে রে!
কী তৃষা তার!...
কী নিবেদন!...
মাগছে কিসের ভিখ্!...
উদ্যত পথিক
হঠাত্ কেন যাচ্ছে থেমে,---
আজকে হঠাত্ থামতে কেন হয়!
--এই বিজয়ী কার কাছে আজ মাগছে পরাজয়|
পথ-আলেয়ার খেয়ায় ধোঁয়ায় ধ্রুবতারার মতন কাহার আঁখি
আজকে নিল ডাকি
হালভাঙা এই ভূতের জাহাজটারে!
মড়ার খুলি,--পাহাড়-প্রমাণ হাড়ে
বুকে তাহার জমে গেছে কত শ্মশান-বোঝা!
আক্রোশে হা ছুটছিল সে একরোখা,--একসোজা
চুম্বকেরি ধবংশ-গিরির পানে,
েনাঙর-হারা মাসুত্মলেরি টানে!
প্রেতের দলে ঘুরেছিল প্রেমের আসন পাতি,---
জানে কি সে বুকে মাঝে আছে তাহার সাথী!
জানে কি সে ভোরের আকাশ--লক্ষ তারার আলো
তাহার মনের দুয়ার-পথেই নিরিখ হারালো!
জানেনি সে তহার ঠোঁটের একটি চুমোর তরে
কোন্ দিওয়ানার সারেং কাঁদে
নয়নে নীর ঝরে!
কপোত ব্যথা ফাটে রে-কার অপার গগন ভেদি!
তাহার বুকের সীমার মাঝেই কাঁদছে কয়েদী
কোন্ সে অসীম আসি!
লক্ষ সাকীর প্রিয় তাহার বুকে পাশাপাশি
প্রেমের খবর পুছে
কবের থেকে কাঁদতে
‘পেয়ালা দে রে মুঝে!

সাগর-বলাকা

ওরে কিশোর, বেঘোর ঘুমের বেহুঁশ হাওয়া ঠেলে
পাতলা পাখা দিলি রে তোর দূর-দূরাশায় মেলে!
ফেনার বৌয়ের নোন্তা মৌয়ের-মদের গেলাস লুটে,
ভোর-সাগরের শারাবখানায়-মুসল্লাতে জুটে
হিমের ঘুণে বেড়াস খুনের আগুনদানা জ্বেলে!

ওরে কিশোর, অস্ত্মরাগের মেঘের চুমায় রেঙে
নীল নহরের স্বপন দেখে চৈতি চাঁদে জেগে,
ছুটছ তুমি চ্ছলচ্ছল জলের কোলাহলের সাথে কই!
উছলে ওঠে বুকে তোমার আল্তো ফেনা-সই!
ঢেউয়ের ছিটায় মিঠা আঙুল যাচ্ছে ঠোঁটে লেগে!

রে মুসাফের,-পাতাল-প্রেতপুরের মরীচিকা
সাগর-জলের তলে বুঝি জ্বালিয়ে দেছে শিখা!
তাই কি গেলে ভেঙে হেথার বালিয়াড়ির বাwড়!
দিচ্ছ যাযাবরের মতো সাগর-মরু পাড়ি,-
ডাইনে তোমার ডাইনীমায়া-পিছের আকাশ ফিকা|

বাসা তোমার সাত সাগরের ঘূর্ণি হাওয়ার বুকে !
ফুটছে ভাষা কেউটে-ঢেউয়ের ফেনার ফণা ঠুকে|
প্রয়াণ তোমার প্রবালদ্বীপে, পলার মালা গলে
বরুণ-রাীণ ফিরছে যেথা,-মুক্তা-প্রদীপ জ্বলে!
যেথায় মৌন মীনকুমারীর শঙ্খ ওঠেফুঁকে

যেইখানে মূক মায়াবিনীর কাঁকন শুধু বাজে
সাঁজসকালে,-ঢেউয়ের তালে, মাঝসাগরের মাঝে !
যায় না জাহাজ যেথায়,-নাবিক পায় না নাগাল যার,
লঘু উদাস পাখায় ভেসে আঁখির তলে তার
ঘুমের অবুঝ, সে কোন্ সবুজ স্বপন -খোঁজার কাজে!

ওরে কিশোর,-দূর-সোহাগী ঘর -বিবাগী সুখ !
-টুকটুকে কোন্ মেঘের পারে ফুট্ফুটে কার মুখ
ডাকছে তোদের ডাগর কাঁচা চোখের কাছে তার !
-শাদা শকুন- পাখায় যে তাই তুলছে হাহাকার
ফাঁপা ঢেউয়ের চাপা কাঁদন,-ফাঁপর-ফাটা বুক!

বনের চাতক--মনের চাতক

বনের চাতক বাঁধল বাসা মেঘের কিনারায়,-
মনের চাতক হারিেয় গেল দূরের দূরাশায়!
ফুপিয়ে ওঠে কাতর আকাশ সেই হতাশার ক্ষোভে,-
সে কোন্ বোঁটের ফুলের ঠোঁটের মিঠে মদের লোভে
বনের চাতক -মনের চাতক কাঁদছে অবেলায়!

পুবের হাওয়ায় হাপর জ্বেলে, আগুনদানা ফাটে!
কোন্ ডাকিনীর বুকের চিতায় পচিম আকাশ টাটে!
বাদল-বৌয়ের চুমায় মৌয়ের সোয়াদ চেয়ে চেয়ে
বেনের চাতক-মনের চাতক চলছে আকাশ বেয়ে,
ঘাটের ভরা কলসী ও-কার কাঁদছে মাঠে মাঠে !

ওরে চাতক,-বনের চাতক, আয় রে নেমে ধীরে
নিঝুম ছায়া-বৌবা যেথা ঘুমায় দীঘি ঘিরে,
‘দে জল! ব লে ফোঁপাস্ কেন ? মাটির কোলে জল
খবর-খোঁজা সোজা চোেখর সোহাগে ছল্ছল্!
মজিস নে রে আকাশ-মরুর মরীচিকার তীরে!

বনের চাতক,-হতাশ উদাস পাখায় দিয়ে পাড়ি
কোথায় গেলে ঘরেরকোলের কানা কানা ছাড়ি ?
ননীর কলস আছে রে তার কাঁচা বুকের কাছে,
আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায় ঘিরে আছে!
আয় রে ফিরে দানোয়-পাওয়া,-আয় রে তাড়াতাড়ি!

বনের চাতক-মনের চাতক আসে না আর ফিরে,
কপোত-ব্যথা বাজায় মেঘের শকুনপাখা ঘিরে!
সে-কোন্ ছুঁড়ির চুড়ি আকাশ -শুঁড়িখানায় বাজে!
চিনিমাখা ছায়ায় ঢাকা চুনীর ঠোঁটের মাঝে
লুকিয়ে আছে সে-কোন্ মধু মৌমাছিদের ভিড়ে!

নাবিক

করে তব হৃদয়ের নদী
বরি নিল অসম্বৃত সুনীল জলধি!
সাগর-শকুন্ত্ম-সম উল্লাসের রবে
দূর সিন্ধু-ঝটিকার নভে
বাজিয়া উঠিল তব দূরন্ত্ম যৌবন!
--পৃথ্বীর বেলায় বসি কেঁদে মরে আমাদের শৃঙ্খলিতমন!
কারাগার-মর্মরের তলে
নিরাশ্রয় বন্দীদের খেদ-কোলাহলে
ভরে যায় বসুধার আহত আকাশ!
অবনত শিরে মোরা ফিরিতেছি ঘৃণ্য বিধিবিধানের দাস!-
--সহস্রের অঙ্গুলিতর্জন
নিত্য সহিতেছি মোরা,--বারিধির বিপ্লব-গর্জন
বরিয়া লয়েছ তুমি,--তারে তুমি বাসিয়াছ ভালো;
তোমার পঞ্জরতলে টগবগ্ করে খুন--দূরন্ত্ম ঝাঁঝালো!
তাই তুমি পদাঘাতে ভেঙে গলে অচেতনবসুধার দ্বার,
অবগুন্ঠিতার
হিমকৃষ্ঞ অঙ্গুলির কন্কাল-পরশ
পরিহরি গেলে তুমি,--মৃত্তিকার মদ্যহীন রস
তুহিন নির্বিষ নিঃস্ব পানপাত্রখানা
চকিতে চূর্ণিয়া গেলে,--সীমাহারা আকাশের নীল শামিয়ানা
বাড়ব-আরক্ত স্ফীত বারিধির তট,
তরঙ্গের তুঙ্গ গিরি, দুর্গম সন্কট
তোমারে ডাকিয়া নিল মায়াবীর রাঙা মুখ তুলি!
নিমেষে ফেলিয়া গেলে ধরণীর শূন্য ভিক্ষাঝুলি!
প্রিয়ার পাণ্ডুর আঁখি অশ্রু-কুহেলিকা-মাখা গেলে তুমি ভুলি!
ভিেল গেলে ভীরু হৃদিেয়র ভিক্ষা, আতুরের লজ্জা অবসাদ
অগাধের সাধ
তোমারে সাজায়ে দেছে ঘরছাড়া ক্ষ্যাপা সিন্দবাদব!
মণিময় তোরণের তীরে
মৃত্তিকার প্রমোদ-মন্দিরে
নৃত্য-গীত-হাসি-অশ্রু-উত্সবের ফাঁদে
হে দূরন্ত্ম দুর্নিবার,--প্রাণ তব কাঁদে!
ছেড়ে গেলে মর্মন্তুদ সর্মর বেষ্টন,
সমুদ্রের যৌবন-গর্জন
তোমারে ক্ষ্যাপায়ে দেছে, ওহে বীর-শের|
টাইফুন-ডন্কার হর্ষে ভুলে গছে অতীত-আখের
হে জলধি-পাখি!
পক্ষে তব নাচিতেছে লক্ষ্যহারা দামিনী-বৈশাখী!
ললাটে জ্বলিছে তব উদয়াস্ত্ম আকাশের রত্নচুড় ময়ূখের টিপ,
কোন্ দূর দারুচিনি লবঙ্গের সুবাসিত দ্বীপ
করিতেছে বিভ্রান্ত্ম তোমারে!
বিচিত্র বিহঙ্গ কোন্ মনিময় তোরণের দ্বারে
সহর্ষ নয়ন মেলি হেরিয়াছ কবে!
কোথা দূরে মায়াবনে পরীদল মেতেছে উত্সবে,--
স্ত্মম্ভিত নয়নে
নীল বাতায়নে
তাকায়েছ তুমি!
অতিদূর আকাশের সন্ধ্যারাগ-প্রতিবিম্বে প্রস্ফুটিত সমুদ্রের
আচম্বিত ইন্দ্রজাল চুমি
সাজিয়াছ বিচিত্র মায়াবী!
সৃজনের জাদুঘর-রহস্যের চাবি
আনিয়াছ কবে উণ্মোচিয়া
হে জল-বেদিয়া!
অলক্ষ্য বন্দর পানে ছুটিতেছ তুমি চিশিদিন
সিন্ধু-বেদুইন!
নাহি গৃহ--নাহি পান্থশালা--
লক্ষ লক্ষ ঊর্মি-নাগবালা
তোমারে নিতেছে ডেকে রহস্য-পাতালে--
বারুনী যেথঅয় তার সণিদীপ জ্বালে!
প্রবাল-পালন্ক-পাশে মীননারী ঢুলায় চামর!
সেই দূরাশার মোহে ভুলে গেছ পিছু-ডাকা স্বর,
ভুলেছ নোঙর!
কোন দূর কুহকের কূল
লক্ষ্য করি ছুটিতেছেঠ নাবিকের হৃদয়-মাস্ত্মল
কেবা  তাহা জানে!
অচিন আকাশ তারে কোন কথা কয় কানে কানে!

বেদিয়া

চুলিচালা সব ফেলেছে সে ভেঙে, পিঞ্জিরহারা পাখি!
পিছু -ডাকে কভু আসে না ফিরিয়া, কে তারে আনবি ডাকি ?
উদাস উদাও হাওয়ার মতন চনিতে যায় সে উড়ে,
গলাটি তাহার সেধেছে অবাধ নদী-ঝণা©র সুরে ;
নয় সে বান্দা রংমহলের, মোতিমহলের বাঁদী,
ঝোড়ো হাওয়া সে যে, গৃহ-প্রাঙ্গনে কে তারে রাখিবে বাঁধি!
কোন্ সুদূরের বেনামী পথের নিশানা নেছে সে চিনি,
ব্যর্থ ব্যথিত প্রান্ত্মর তার চরন-চিহ্ন বিনে !
যুগযুগান্ত্ম কত কান্ত্মার তার পানে আছে চেয়ে,
কবে সে আসিবে ঊষর ধূসর বালুকা-পথটি বেয়ে,
তারি প্রতীক্ষা মেগে বসে আছে ব্যাকুল বিজন মরু|
দিকে দিকে কত নদী- নির্ঝর কত গিরি-চুড়া-তরু
ঐ বাঞ্ছিত বন্ধুর তরে আসন রেখেছে পেতে
কালো-মৃত্তিকা ঝরা-কুসুমের বন্দনা-মালা গেঁথে
ছড়ায়ে পরিছে দিকেদিগন্ত্মে ক্ষ্যাপা পথিকের লাগি!
বাবলা বনের মৃদুল গন্ধে বন্ধুর দেখা মেগি
লুটায়ে রয়েছে কোথা সীমান্ত্মে শরত্ -ঊষার শ্বাস!
ঘুঘু- হরিয়াল - ডাহুক - গাঙচিল - বুনোহাঁস
নিবিড় কাননে তটিনীর কূলে যায় ফিরে ফিরে
বহু পুরাতন পরিচিত সেই সঙ্গী আসিল কি রে !
তারি লাগি ভায় ইন্দ্রধনুক নিবিড় মেঘের কূলে,
তারি লাগি আসে জোনাকি নামিয়া গিরিকন্দর মূলে!
ঝিনুক-নুড়ির অঞ্জলি ল য়ে কলরব ক রে ছুটে
নাচিয়া আসিছে অগাধ সিন্ধু তারি দু টি করপুটে|
তারি লাগি কোথা বালুপথে দেখা দেয় হীরকের কোণা,
তাহারি লগিয়া উজানী নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসে সোনা!
চরকিতে পরশপাথর কুরায়ে বালকের মত হাসে
ছুঁড়ে ফেলে দেয় উদাসী বেদিয়া কোন্ সে নিরুদ্দেশে!
যত্ন করিয়া পালক কুড়ায়, কানে গোঁজে বনফুল,
চাহে না রতন -মণি-মঞ্জুষা হীরা-মানিকের দুল্,
-তার চেয়ে ভালো অমন ঊষার কনক-রোদের সিঁথি,
তার চেয়ে ভালো আলো-ঝল্মল্ শীতল শিশির- বীথি,
তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিন জটা,
তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা!
কি ভাষা বলে সে, কি বাণি জানায়, কিসের বারতা বহে!
মনে হয় যেন তারি তরে তবু দুটি কান পেতে রহে
আকাশ-বাতাস-আলোক-আঁধার মৌন স্বপ্নভরে,
মনে হয় যেন নিখিল বিশ্ব কোল পেতে তার তরে!

মরীচিকার পিছে

ধূম্র তপ্ত আঁধির কুয়াশা তরবারি দিয়ে চিরে
সুন্দর দূর মরীচিকাতটে ছলনামায়ার তীরে
ছুটে যায় দুটি আঁখি!
--- ককত দূর হায় বাকি!
উধাও অশ্ব বল্গাবিহীন অগাধ মরুভূ ঘিরে,
পথে পথে তার বাধা জ্থমে যায়, --- তবু সে আসে না ফিরে!

দূরে, --দূরে, ---আরো দূরে, ---আরো দূরে,
অসীম মরুর পারাবার-পারে আকাশ-সীমানা জুড়ে
ভাসিয়াছে মরুতৃষা!
--- হিয়া হারায়েছে দিশা!
কে যেন ডাকিছে আকুল অলস উদাস বাঁশির সুরে
কোন্ দিগন্ত্মে নির্জন কোন মৌন মায়াবী-পুরে!

কোন্ এক সুনীল দরিয়া সেথায় উথলিছে অনবিার!
--- কান পেতে একা শুনেছে সে তার অপরূপ ঝং্কার,
ছোটে অঞ্জলি পেতে,
তৃষার নেশায় মেতে,
উষর ধূরস মরুর মাঝারে এমন খেয়াল কার!
খুলিয়া দিয়াচে মাতাল ঝর্ণা না জানি কে দিলদার!

কে যেন রেখেছে সবুজ ঘাসের কোমল গালিচা পাতি
যত খুন যত খারাবীর ঘোরে পরান আছিল মাতি,
নিমেষে গিয়েছে ভেঙে
স্বপন-আবেশে রেঙে
আঁখি দুটি তার জৌলস্-রাঙা হয়ে গেছে রাতারাতি!
কোন্ যেন এক জিন-সর্দার সেজেছে তাহার সাথী

কোন যেন পরী চেয়ে আছে দুটি চঞ্চল চোখ তুলে!
পাগ্লা হাওয়ায় অনিবার তার ওড়ানা যেতেছে দুলে!
গেঁথে গোলাপের মালা
তাকায়ে রয়েছে বালা,
বিলায়ে দিয়েছে নার্গিস্ কালো পশ্মিনা চুলে!
বসেছে বালিকা খর্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কুলে|

ছুটিছে ক্লিষ্ট ক্লান্ত্ম অশ্ব কশাঘাত-জর্জর,
চারিদিকে তার বালুর পাথার,---মরুর হাওয়ার ঝড়;
নাহি শ্রান্ত্মির লেশ,
সুদূর নিরুদ্দেশ---
অসীম কুহক পাতিয়া রেখেছে তাহার বুকে র পর!
পথের তালাশে পাগল সোয়ার হারায়ে ফেলেছে ঘর!

আঁখির পলকে পাহাড়ের পারে কোথা সে ছুটিয়া যায়!
চকিত আকাশ পায় না তাহার নাগাল খুঁজিয়া হায়!
ঝড়ের বাতাস মিছে
ছুটিছে তাহার পিছে!
মরুভূর প্রেত চমকিয়া তার চক্ষের পানে চায়,---
সুরার তালাশে চুমুক দিল কে গরলের পেয়ালায়!

জীবন-মরণ দুয়ারে আমার
সরাইখানার গোলমাল আসে কানে,
ঘরের শার্শি বাজে তাহাদের গানে,
পর্দা যে উড়ে যায়
তাদের হাসির ঝড়ের আঘাতে হায়!
----মদের পাত্র গিয়েছে কবে যে ভেঙে!
আজো মন ওঠে রেঙে
দিলদারদের দরাজ গলার রবে,
সরায়ের উত্সবে!
কোন্ কিশোরীর চুড়ির মতন হায়
পেয়ালা তাদের থেকে থেকে বেজে যায়্
বেহুঁশ হাওয়ার বুকে!
সারা জনমের শুষে-নরেয়া খুন নেচে ওঠে মোর মুখে!
পাণ্ডুর দুটি ঠোঁটে
ডালিমফুলের রক্তিম আভা চকিতে আবার ফোটে!
মনের ফলকে জ্বলিছে তাদের হাসিভরা লাল গাল,
ভুলে গেছে তারা এই জীবনের যত কিছু জঞ্জাল|
আখেরের ভয় ভুলে
দিলওয়ার প্রাণ কুলে
জীবন-রবাবে টানিছে খ্সিপ্ত ছড়ি!
অদূরে আকাশে মধুমালতীর পাপড়ি পড়িছে ঝরি,---
নিভিছে দিনের আলো
---জীবন-মরণ দুয়ারে আমার, কারে যে বাসিব ভালো
একা একা তাই ভাবিয়া মরিছে মন!
পূর্ণ হয়নি পিপাসী প্রাণের একটি অকিঞ্চন,
খুলিনী একটি দল,---
যৌবন-শতদলে মোর হায় ফোটে নাই পরিমল!
উত্সবলোভী অলি
আসেনি হেথায়,---
কীটের আঘাতে শুকায়ে গিয়েছে কবে কামনার কলি!
---সারাটি জীবকন বাতায়নখানি খুলে
তাকায়ে দেখেছি নগরী-মরুতে ক্যারাভেন্ যায় দুলে
আশা-নিরাশার বালূ-পারাবার বেয়ে,
সুদূর মরূদ্যানের পানেতে চেয়ে!
সুখ-দুঃখের দোদুল ঢেউয়ের তালে
নেচেছে তাহারা, --মায়াবীর জাদুজালে
মাতিয়া গিয়েছে খেয়ালী মেজাজ খুলি,
মৃগতৃষ্ঞার মদের নেশায় ভুলি!
মস্ত্মানা সেজে ভেঙেগ গেছে ঘর-দোর,
লোহার শিকের আড়ালে জীবন লুটায়ে কেঁদেছে মোর!
কারার ধূলায় লুণ্টিত হয়ে বান্দার মতো হায়
কেঁদেছে বুকের বেদঈন মোর দূরাশার পিপাসায়!
জীবনপথের তাতার দসু্যগুলি
হুল্লোড় তুলি উড়ায়ে গিয়েছে ধূলি
মোর গবাক্ষে কবে!
কণ্ঠ-বাজের আওয়াজ তাদের বেজেছে স্ত্মব্ধ নভে!
আতুর নিদ্রা চকিতে গিয়েছে ভেঙে,
সারাটি নিশীথ খুন্-রোশ্নাই প্রদীপে মনটি রেঙে
একাকী রয়েছি বসি,
নিরালা গগনে কখন নিভেছে শশী
পাইন যে তাহা টের!
---দূর দিগন্ত্মে চলে গেছে কোথা খুশ্রোজী মুসাফের!
কোন্ সুদূরের তুরাণী প্রিয়ার তবে
বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে!
দীর্ঘ দিবস বয়ে গেছে যারা হাসি অশ্রুর বোঝা
আমার গগনে ‘ঈদরাত কভু দেয়নি যে হায় দেখা,
পরানে কখনো জাগেনি ‘রোজার ঠেকা!
কি যে মিঠা এই সুখের দুখের ফেনিল জীবনখানা!
এই যে নিষেধ, এই যে বিধান,--আইন-কানুন, এই যে শাসন মানা,
ঘরদোর-ভাঙা তুমূল প্রলয়ধ্বনি
নিত্য গগনে এই যে উঠিছে রণি
যুবানবীনের নটনর্তন তালে,
ভাঙনের গান এই যে বাজিছে দেশে দেশে কালে কালে,
এই যে তৃষ্ঞা-দৈন্য-দূরাশা-জয়-সংগ্রাম-ভুল
সফেন সুরার ঝাঁঝের মতন করে দেয় মজ্গুল
দিওয়ানা প্রাণের নেশা!
ভগবান,--ভগবান,--তুমি যুগ যুগ থেকে ধরেছ শুঁড়ির পেশা!
---লাখো জীবনের শূন্য পেয়ালা ভরি দিয়া বারবার
জীবন-পান্থাশালার দেয়ালে তুলিতেছে ঝন্কার,--
মাতালের চীত্কার!
অনাদি কালের থেকে;
মরণশিয়রে মাথা পেতে তার দস্তুর যাই দেখে!
হেরিলারম দুরে বালুকার পরে রূপার তাবিজ প্রায়
জীবরেন নদী কলরোলে বয়ে যায়!
কোটি শূঁড় দিয়ে দুখের মরুভূ নিতেছে তাহারে শুষে,
ছলা-মরীচিকা জ্বলিতেছে তার প্রানের খেয়াল-খুশে|
মরণ-সাহারা আসি
নিতে চায় তারে গ্রাসি| ---
তবু সে হয় না হারা
ব্যাথার রুধির-ধারা
জীবন-মদের পাত্র জুড়িয়া তার
যুগ যুগ ধরি অপরূপ সুরা গাড়িছে মশলাদার!

কিশোরের প্রতি

যৌবনের সুরাপাত্র গরল-মদির
ঢালোনি অধরে তব, ধরা-মোহিনীর
ঊর্ধ্বফণা মায়া-ভুজঙ্গিনী
আসেনি তোমার কাম্য উরসের পথটুকু চিনি,
চুমিয়া চুমিয়া তব হৃদয়ের মধূ
বিষবহ্নি ঢালেনিকো বাসনার বধূ
অন্ত্মরের পানপাত্রে তব;
অম্লান আনন্দ তব, আপ্লুত উত্সব,
অশ্রুহীন হাসি,
কামনার পিছে ঘুরে সাজোনি উদাসী|
ধবল কাশের দলে, আশ্বিনের গগনের তলে
তোর তরে রে কিশোর, মৃগতৃষ্ঞা কভু নাহি জ্বলে!
নয়নে ফোটে না তব মিথ্যা মরূদ্যান|
অপরূপ রূপ-পরীস্থান
দিগন্ত্মের আগে
তোমার নির্মেঘ-চক্ষে কভু নাহি জাগে!
আকাশকুসমবীথি দিয়া
মাল্য তুমি আনো না রচিয়া,
উধাও হও না তুমি আলেযার পিছে
ছলাময় গগনের নিচে!
--- রূপ-পিপাসায় জ্বলি মৃতু্যর পাথারে
স্পন্দহীন প্রেতপুরদ্বারে
করোনিকো করাঘাত তুমি
সুধার সন্ধানে লক্ষ বিষপাত্র চুমি
সাজোনিকো নীলকণ্ঠ ব্যাকুল বাউল!
অধরে নাহিকো তৃষ্ঞা, চক্ষে নাহি ভুল,
রকেত্ তব অলক্ত যে পরে নাই আজো রাণী,
রুধির নিঙাড়ি তব আজো দেবী মাগে নাই রক্তিম চন্দন|
কারাগার নাহি তব, নাহিকো বন্ধন;
দীঘল পতাকা, বর্শা তন্দ্রাহারা প্রহলরি লওনি তুলিয়া,
--- সুকুমার কিশোরের হিয়অ!
--- জীবন-সৈকতে তব দুলে যায় লীলায়িত লঘুনৃত্য নদী,
বক্ষে তব নাচেনিকো যৌবনের দুরন্ত্ম জলধি;
শূল-তোলা শম্ভুর মতন
আস্ফোলিয়া উটে নাই মন
মিথ্যা বাধা-বিধানের ধ্বংসের উল্লাসে!
তোমার আকাশে
দ্বাদশ সূর্যের বহ্নি ওঠেনিকো জ্বলি
কক্ষচ্রূত উলল্কাসম পড়েনিকো স্খলি,
কুজঝটিকা-আবর্তের মাঝে
অনির্বাণ স্ফুলিঙ্গের সাজে!
সব বিঘ্ন সকল আগল
ভাঙিয়া জাগোনি তুমি স্পন্দন-পাগল
অনাগত স্বপ্নের সন্ধানে
দূরন্ত্ম দূরাশা তুমি জাগাওনি প্রাণে|
নিঃস্ব দুটি অঞ্জলির আকিঞ্চন মাগি
সাজোনিকো দিক্ভোরো দিওয়ানা বৈরাগী!
পথে পথে wভক্ষা মেগে কাম্য কল্পতরু
বাজাওনি শ্মশান-ডমরু!
জ্যোত্স্নাময়ী নিশি তব, জীবনের অমানিশা ঘোর
চক্ষে তব জাগেনি কিশোর!
আঁধারের নির্বিকল্প রূপ,
স্পন্দহীন বেদনার কূপ
রুদ্ধ তব বুকে;
তোমার সম্মুখে
ধরিত্রী জাগিছে ফুল্ল-সুন্দরীর বেশে,
নিত্য বেলাশেষে
যেই পুষ্প ঝরে,
যে বিরহ জাগে চরাচরে
গোধূলির অবসানে শোক-ম্লান সাঁঝে,
তাহার বেদনা তব বক্ষে নাহি বাজে;
আকাঙ্খার অগ্নি দিয়া জ্বাল নাই চিতা,
ব্যাথার সংহিতা
গাহ নাই তুমি!
দরিয়ার তীর ছাড়ি দেখ নাই দাব মরুভূমি
জ্বলন্ত্ম নিষ্ঠুর!
নগরীর ব্ধুব্ধ বক্ষে জাগে যেই মৃতু্যপ্রেতপুর,
ডাকিনীর রুক্ষ অট্টহাসি
ছন্দ তার মর্মে তব ওঠে না প্রকাশি!
সভ্যতার বীভত্স ভৈরবী
মলিন করেনি তব মানসের ছবি,
ফেনিল করেনি তব নভোনীল, প্রভাতের আলো,
এ উদ্ভ্রান্ত্ম যুবকের বক্ষে তার রশ্মি আজ ঢালো, বন্ধু, ঢালো|

নব নবীনের লাগি

---নব নবীনের লাগি
প্রদীপ ধরিয়া আঁধারের বুকে আমরা রয়েছি জাগি!
ব্যর্থ পঙ্গ খর্ব প্রাণের বিকল শাসন ভেঙে,
নব আকাঙ্খা আশার স্বপনে হৃদয়ে মোদের রেঙে,
দেবতার দ্বারে নবীন বিধান---নতুন ভিক্ষা মেগে
দাঁড়ায়েছি মোরা তরুণ প্রাণের অরুণের অণুরাগী!

ঝড়ের বাতাস চাই!
---চারিদিক ঘিরে শীতের কুহেলি,---শ্মশানপথের ছাই,
ছড়ায়ে রয়েছে পাহাড়প্রমাণ মৃতের অস্থি খুলি,
কে সাজাবে ঘর দেউলের পর কন্কাল তুলি তুলি?
সূর্য চন্দ্র নিভায়ে কে নেবে জরার চোখের ঠুলি!
---মরার ধরায় জ্যান্ত্ম কখনো মাগিতে যাবে কি টাঁই!

ঘুমায়ে কে আছে ঘরে!
মৃতশিশু বুকে কল্যাণী পুরকামিনী কি আজ মরে!
কে আছে বসিয়া হতাশ উদাস অলস অন্যমনা?
দোদুল আকাশে দুলিয়া উঠিছে রাঙা অশনির ফণা,
বাজে বাদলের রঙ্গমল্লি, ঝঞ্ঝার ঝঞ্ঝনা!
ফিরিছে বালক ঘর-পলাতক ঝরা পালকের ঝড়ে!

আমরা অশ্বারোহী!---
যাযাবার যুবা, বন্দিনীদের ব্যথা মোরা বুকে বহি,
মানবের মাঝে যে দেবতা আছে আমরা তাহারে বরি,
মোদের প্রাণের পূজার দেউলে তাহার প্রতিমা গড়ি,
চুয়া-চন্দন-গন্ধ বিলায়ে আমরা ঝরিয়া পড়ি,
সুবাস ছড়াই উশীরের মতো,---ধূপের মতন দহি!

গাহি মানবে জয়!
--কোটি কোটি বুকে কোটি ভগবান আঁখি মেলে জেগে রয়!
সবার প্রাণের অশ্রু-বেদনা মোদের বক্ষে লাগে,
কোটি বুকে কোটি দেউটি জ্বলিছে,---কোটি কোটি শিখা জাগে,
প্রদীপ নিভায়ে মানবদেহের দেউল যাহারা ভাঙে,
আমরা তাদের শস্ত্র, আসন করিব ক্ষয়!
জয় মানবের জয়!

নীলিমা

রৌদ্র ঝিল্মিল্,
ঊষার আকাশ, মধ্যনিশীথের নীল,
অপর ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দার বারেবারে
নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে!
--উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী,
উগ্র চল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,
আরক্ত কন্করগুলি মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
---মরীচিকা-ঢাকা!
আগণন যাতিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার,---পায় নাকো পথের সন্ধান;
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল,---
হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধি-বিধানের এই কারাতল
তোমার ও-মায়াদণ্ডে ভেঙেছ মায়াবী|
জনতার কোলাহলে এক বসে ভাবি
কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্ত্মবের রক্ততটে আসিলে একাকী!
স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা
মৌন স্বপ্ন-ময়ুরের ডান!
চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধা ধরণীর রুধির-লিপিকা
জ্বলে ওঠে অন্ত্মহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!
বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত,
ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি,---ধুম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়,---স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
---শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে, শুক্লাাকাশে, নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার চকিত স্পর্শে হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!

আমি কবি,---সেই কবি

আমি কবি,---সেই কবি,---
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আন্মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামান জাগিছে প্রাণে!
বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরীর গানে!
দাদূরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!

স্বপন-সুরার ঘোরে
আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা করে!
জনম ভরিয়া সে কোন হেঁয়ালি হল না আমার সাধতে
পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়, ---পথে পথে ধায় ধাঁধাঁ!
---নিমিষে পাসরি এই বসুধার নিয়নি মানার বাধা
সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভরে!

ভুঁয়ের চাঁপাটি চুমি
শিশুর মতন,---শিরীষের বুকে নীরবে পড়ি গো নুমি|
ঝাউয়ের কানকে মিঠা মাঠে মাঠে মটরক্ষেতের শেষে
তাতার মতন চকিতে কখন ইম আসিয়াছি ভেসে!
---ভাটিয়াল সুর সাঁঝের আঁধারে দরিয়ার পারে মেশে,---
বালুর ফরাশে ঢালু নদীটির জলে ধোঁয়া ওঠে ধূমি!

বিজন তারা সাঁঝে
আমার প্রিয়ের গজল-গানের ররেয়াজ বুঝি বা বাজে!
পড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখির নষ্ট নীড়!
কোন্ যেন এক সুদূর আকাশ গোধূলিলোকের তীর
কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে অকাজের মাঝে!

The text publised in this blog is written by Jibanananda Das. Jibanananda Das (Bengali: জীবনানন্দ দাশ, /dʒɪbɒnʌnɒndɔː dʌʃ/) (17 February 1899 – 22 October 1954) was a Bengali poet, writer, novelist and essayist. Due to copyright law of Bangladesh and India His works are available under public domain from 2014 after 60 years of his death. Me being an admirer of his work, took the liberty to type and publish this text online. This text is not proof read and not complete. In case of any dispute please contact me snewaj at gmail dot com.