রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৪

মরীচিকার পিছে

ধূম্র তপ্ত আঁধির কুয়াশা তরবারি দিয়ে চিরে
সুন্দর দূর মরীচিকাতটে ছলনামায়ার তীরে
ছুটে যায় দুটি আঁখি!
--- ককত দূর হায় বাকি!
উধাও অশ্ব বল্গাবিহীন অগাধ মরুভূ ঘিরে,
পথে পথে তার বাধা জ্থমে যায়, --- তবু সে আসে না ফিরে!

দূরে, --দূরে, ---আরো দূরে, ---আরো দূরে,
অসীম মরুর পারাবার-পারে আকাশ-সীমানা জুড়ে
ভাসিয়াছে মরুতৃষা!
--- হিয়া হারায়েছে দিশা!
কে যেন ডাকিছে আকুল অলস উদাস বাঁশির সুরে
কোন্ দিগন্ত্মে নির্জন কোন মৌন মায়াবী-পুরে!

কোন্ এক সুনীল দরিয়া সেথায় উথলিছে অনবিার!
--- কান পেতে একা শুনেছে সে তার অপরূপ ঝং্কার,
ছোটে অঞ্জলি পেতে,
তৃষার নেশায় মেতে,
উষর ধূরস মরুর মাঝারে এমন খেয়াল কার!
খুলিয়া দিয়াচে মাতাল ঝর্ণা না জানি কে দিলদার!

কে যেন রেখেছে সবুজ ঘাসের কোমল গালিচা পাতি
যত খুন যত খারাবীর ঘোরে পরান আছিল মাতি,
নিমেষে গিয়েছে ভেঙে
স্বপন-আবেশে রেঙে
আঁখি দুটি তার জৌলস্-রাঙা হয়ে গেছে রাতারাতি!
কোন্ যেন এক জিন-সর্দার সেজেছে তাহার সাথী

কোন যেন পরী চেয়ে আছে দুটি চঞ্চল চোখ তুলে!
পাগ্লা হাওয়ায় অনিবার তার ওড়ানা যেতেছে দুলে!
গেঁথে গোলাপের মালা
তাকায়ে রয়েছে বালা,
বিলায়ে দিয়েছে নার্গিস্ কালো পশ্মিনা চুলে!
বসেছে বালিকা খর্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কুলে|

ছুটিছে ক্লিষ্ট ক্লান্ত্ম অশ্ব কশাঘাত-জর্জর,
চারিদিকে তার বালুর পাথার,---মরুর হাওয়ার ঝড়;
নাহি শ্রান্ত্মির লেশ,
সুদূর নিরুদ্দেশ---
অসীম কুহক পাতিয়া রেখেছে তাহার বুকে র পর!
পথের তালাশে পাগল সোয়ার হারায়ে ফেলেছে ঘর!

আঁখির পলকে পাহাড়ের পারে কোথা সে ছুটিয়া যায়!
চকিত আকাশ পায় না তাহার নাগাল খুঁজিয়া হায়!
ঝড়ের বাতাস মিছে
ছুটিছে তাহার পিছে!
মরুভূর প্রেত চমকিয়া তার চক্ষের পানে চায়,---
সুরার তালাশে চুমুক দিল কে গরলের পেয়ালায়!

জীবন-মরণ দুয়ারে আমার
সরাইখানার গোলমাল আসে কানে,
ঘরের শার্শি বাজে তাহাদের গানে,
পর্দা যে উড়ে যায়
তাদের হাসির ঝড়ের আঘাতে হায়!
----মদের পাত্র গিয়েছে কবে যে ভেঙে!
আজো মন ওঠে রেঙে
দিলদারদের দরাজ গলার রবে,
সরায়ের উত্সবে!
কোন্ কিশোরীর চুড়ির মতন হায়
পেয়ালা তাদের থেকে থেকে বেজে যায়্
বেহুঁশ হাওয়ার বুকে!
সারা জনমের শুষে-নরেয়া খুন নেচে ওঠে মোর মুখে!
পাণ্ডুর দুটি ঠোঁটে
ডালিমফুলের রক্তিম আভা চকিতে আবার ফোটে!
মনের ফলকে জ্বলিছে তাদের হাসিভরা লাল গাল,
ভুলে গেছে তারা এই জীবনের যত কিছু জঞ্জাল|
আখেরের ভয় ভুলে
দিলওয়ার প্রাণ কুলে
জীবন-রবাবে টানিছে খ্সিপ্ত ছড়ি!
অদূরে আকাশে মধুমালতীর পাপড়ি পড়িছে ঝরি,---
নিভিছে দিনের আলো
---জীবন-মরণ দুয়ারে আমার, কারে যে বাসিব ভালো
একা একা তাই ভাবিয়া মরিছে মন!
পূর্ণ হয়নি পিপাসী প্রাণের একটি অকিঞ্চন,
খুলিনী একটি দল,---
যৌবন-শতদলে মোর হায় ফোটে নাই পরিমল!
উত্সবলোভী অলি
আসেনি হেথায়,---
কীটের আঘাতে শুকায়ে গিয়েছে কবে কামনার কলি!
---সারাটি জীবকন বাতায়নখানি খুলে
তাকায়ে দেখেছি নগরী-মরুতে ক্যারাভেন্ যায় দুলে
আশা-নিরাশার বালূ-পারাবার বেয়ে,
সুদূর মরূদ্যানের পানেতে চেয়ে!
সুখ-দুঃখের দোদুল ঢেউয়ের তালে
নেচেছে তাহারা, --মায়াবীর জাদুজালে
মাতিয়া গিয়েছে খেয়ালী মেজাজ খুলি,
মৃগতৃষ্ঞার মদের নেশায় ভুলি!
মস্ত্মানা সেজে ভেঙেগ গেছে ঘর-দোর,
লোহার শিকের আড়ালে জীবন লুটায়ে কেঁদেছে মোর!
কারার ধূলায় লুণ্টিত হয়ে বান্দার মতো হায়
কেঁদেছে বুকের বেদঈন মোর দূরাশার পিপাসায়!
জীবনপথের তাতার দসু্যগুলি
হুল্লোড় তুলি উড়ায়ে গিয়েছে ধূলি
মোর গবাক্ষে কবে!
কণ্ঠ-বাজের আওয়াজ তাদের বেজেছে স্ত্মব্ধ নভে!
আতুর নিদ্রা চকিতে গিয়েছে ভেঙে,
সারাটি নিশীথ খুন্-রোশ্নাই প্রদীপে মনটি রেঙে
একাকী রয়েছি বসি,
নিরালা গগনে কখন নিভেছে শশী
পাইন যে তাহা টের!
---দূর দিগন্ত্মে চলে গেছে কোথা খুশ্রোজী মুসাফের!
কোন্ সুদূরের তুরাণী প্রিয়ার তবে
বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে!
দীর্ঘ দিবস বয়ে গেছে যারা হাসি অশ্রুর বোঝা
আমার গগনে ‘ঈদরাত কভু দেয়নি যে হায় দেখা,
পরানে কখনো জাগেনি ‘রোজার ঠেকা!
কি যে মিঠা এই সুখের দুখের ফেনিল জীবনখানা!
এই যে নিষেধ, এই যে বিধান,--আইন-কানুন, এই যে শাসন মানা,
ঘরদোর-ভাঙা তুমূল প্রলয়ধ্বনি
নিত্য গগনে এই যে উঠিছে রণি
যুবানবীনের নটনর্তন তালে,
ভাঙনের গান এই যে বাজিছে দেশে দেশে কালে কালে,
এই যে তৃষ্ঞা-দৈন্য-দূরাশা-জয়-সংগ্রাম-ভুল
সফেন সুরার ঝাঁঝের মতন করে দেয় মজ্গুল
দিওয়ানা প্রাণের নেশা!
ভগবান,--ভগবান,--তুমি যুগ যুগ থেকে ধরেছ শুঁড়ির পেশা!
---লাখো জীবনের শূন্য পেয়ালা ভরি দিয়া বারবার
জীবন-পান্থাশালার দেয়ালে তুলিতেছে ঝন্কার,--
মাতালের চীত্কার!
অনাদি কালের থেকে;
মরণশিয়রে মাথা পেতে তার দস্তুর যাই দেখে!
হেরিলারম দুরে বালুকার পরে রূপার তাবিজ প্রায়
জীবরেন নদী কলরোলে বয়ে যায়!
কোটি শূঁড় দিয়ে দুখের মরুভূ নিতেছে তাহারে শুষে,
ছলা-মরীচিকা জ্বলিতেছে তার প্রানের খেয়াল-খুশে|
মরণ-সাহারা আসি
নিতে চায় তারে গ্রাসি| ---
তবু সে হয় না হারা
ব্যাথার রুধির-ধারা
জীবন-মদের পাত্র জুড়িয়া তার
যুগ যুগ ধরি অপরূপ সুরা গাড়িছে মশলাদার!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

The text publised in this blog is written by Jibanananda Das. Jibanananda Das (Bengali: জীবনানন্দ দাশ, /dʒɪbɒnʌnɒndɔː dʌʃ/) (17 February 1899 – 22 October 1954) was a Bengali poet, writer, novelist and essayist. Due to copyright law of Bangladesh and India His works are available under public domain from 2014 after 60 years of his death. Me being an admirer of his work, took the liberty to type and publish this text online. This text is not proof read and not complete. In case of any dispute please contact me snewaj at gmail dot com.