বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৪

বিবেকানন্দ

জয়,--তরুণের জয়!
জয় পুরোহিত আহিতাগ্নিক,--জয়,---জয় চিণ্ময়!
স্পর্শে তোমার নিশা টুটেছিল,---উষা উঠেছিল জেগে
পূর্ব তোরণে, বাংলা-আকাশে,---অরুণ-রঙিন মেঘে;
আলোকে তোমার ভারত, এশিয়া,--জগত্ রেঙে|

হে যুবক মুসাফের,
স্থবিরের বুকে ধ্বনিলে শঙ্খ জাগরণপর্বের!
জিঞ্জির-বাঁধা ভীত চকিতেরে অভয় দানিলে আসি,
সুপ্তের বুকে বাজালে তোমার বিষাণ হে সন্ন্যাসী,
রুক্ষের বুকে বাজালে তোমার কালীয়-দমন বাঁশি!

আসিলে সব্যসাচী,
কোদণ্ডে তব নব উল্লাসে নাচিয়া উঠিল প্রাচী!
টন্কারে তব দিকে দিকে শুধু রণিয়া উঠিল জয়,
ডন্কা তোমার উীঠল বাজিয়া মাভৈঃ মন্ত্রময়;
শন্কাহরণ ওহে সৈনিক,---নাহিকো তোমার ক্ষয়!

তৃতীয় নয়ন তব
ম্লান বাসানার মনসিজ নাশি জ্বালাইত উত্সব!
কলুষ-পাতকে, ধূর্জটি, তব পিনাক উঠিত রুখে,
হানিতে আঘাতত দিবানিশি তুমি ক্লেদ-কামনার বুকে,
অসুর-আলয়ে শিব-সন্ন্যাসী বেড়াতে শঙ্খ ফুঁকে!

কৃষ্ঞচক্র সম
ক্লৈব্যের হুদে এসেছিলে তুমি ওগো পুরুষোত্তম,
এসেছিলে তুমি ভিখারীর দেশে ভিখারীর ধন মাগি
নেমেছিলে তুমি বাউলের দলে,---হে তরুণ বৈরাগী!
মর্মে তোমার বাজিত বেদনা আর্ত জীবের লাগি|

হে প্রেমিক মহাজন,
তোমার পানেতে তাকাইল কোটি দরিদ্র-নারায়ণ;
অনাথের বেশে ভগবান এসে তোমার তোরণতলে
বারবার যবে কেঁদে কেঁদে গেল কাতর আঁখির জলে,
অর্পিলে তব প্রীতি-উপায়ন প্রাণের কুসুমদলে!

কোথা পাপী? তাপী কোথা?
----ওােগ ধ্যানী, তুমি পতিত-পাবন যজ্ঞে সাজিলে হোতা!
শিব-সুন্দর-সত্যের লাগি শুরু করে দিলে হোম,
কোটি পঞ্চমা আতুরের তবে কাঁপায়ে তুলিলে ব্যোম,
মন্ত্রে তোমার বাজিল বিপুল শান্ত্মি স্বস্ত্মি ওঁ!

সোনার মুকুট ভেঙে
ললাট তোমার কাঁটার মুকুটে রাখিলে সাধক রেঙে!
স্বার্থ লালসা পাসরি ধরিলে আত্মাহুতির ডালি,
যজ্ঞের যূপে বুকের রুধির অনিবার দিলে ঢালি,
বিভাতি তোমার তাই তো অটুট রহিল অংশুমালী!

দরিয়ার দেশে নদী!
---বোধিসত্ত্বের আলয়ে তুমি গো নবীন শ্যামল ররোধি!
হিংসার রণে আসিলে পথিক প্রেম-খঞ্জর হাতে,
আসিলে করুণা-প্রদীপ হস্ত্মে হিংসার অমারামে,
ব্যাধি মন্বন্ত্মরে এলে তুমি সুধা-জলধির সংঘাতে!

মহামারী ক্রন্দন
ঘুচাইলে তুমি শীতল পরশে,---ওগো সুকোমল চন্দন!
বজ্র-কঠোর, কুসুম-মৃদুল,---আসিলে লোকোত্তর;
হানিলে কুলিশ কখনো,---ঢালিলে নির্মল নির্ঝর,
নাশিলে পাতক,--পাতকীরে তুমি অর্পিলে নির্ভর|

চক্র গদার সাথে
এনেছিলে তুমি শঙ্খ পদ্ম,---হে ঋষি, তোমার হাতে,
এনেছিলে তুমি ঝড় বিদু্যত্,---পেয়েছিলে তুমি সাম,
এনেছিলে তুমি রণ-বিপ্লব,---শান্ত্মি-কুসুম-দাম;
মাভৈঃ শঙ্খে জাগিছে তোমার নর-নারায়ণ-নাম!

জয়,--তরুণের জয়|
আত্মাহুতির রক্ত কখনো আঁধারে হয় না লয়!
তাপসের হাড় বজ্রের মতো বেজে উঠে বারবার!নাহি রে মরণে বিনাশ,--শ্মশানে নসাহw তার সংহার,
দেশে দেশে তার বীণা বাজে---বাজে কালে কালে ঝন্কার!

হিন্দু-মুসলমান
মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে---পুণ্য ভারতপুরে
পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নামাজের সুরে সুরে!
আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে,
মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনিটি গগনে গগনে বাজে;
জপে ঈদগাতে তসবী ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে,
সন্ধ্যা-উষায় বেদবাণী যায় মিশে কোরানের স্বরে;
সন্ন্যাসী আর পীর
মিলে গেছে হেথা,--মিশে গেছে হেথা মসজিদ, মন্দির!

কে বলে হিন্দু বসিয়া রয়েছে একাকী ভারত জাঁকি?
---মুসলমানের হস্ত্মে হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখী,
আরব শিমর তাতার তুর্কি ইরানের চেয়ে মোরা
ওগো ভারতের মোসলেমদল,--তোমাদের বুক-জোড়া!
ইন্দ্রপ্রস্থ ভেঙেছি আমরা,---আর্যাবর্ত ভাঙি
গড়েছি নিwখল নতুন ভারত নতুন স্বপনে রাঙি!
নবীন প্রাণে সাড়া
আকাশে তুলিয়া ছুটিছে মুক্ত যুক্তবেণীর ধারা!


রুমের চেয়রে ভারত তোমার আপন,---তোমার প্রাণ!
---হেথায় তোমার ধর্ম অর্থ,--হেথায় তোমার ত্রাণ;
হেথায় তোমার আসান ভাই গো, হোথায় তোমার আশা;
যুগ যুগ ধরি এই ধূলিতলে বাঁধিয়াছ  তুমি বাসা,
গড়িয়াছ ভাষা কল্পে কল্পে দরিয়ার তীরে বসি,
চক্ষে তোমার ভারতের আলো,---ভারতের রবি, শশী,
হে ভাই মুসলমান,
তোমাদের তরে কোল পেতে আছে ভারতে ভগবান!

এ ভারতভূমি নহেকো তোমার, নহেকো আমার একা,
হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ,---মুসলমানের রেখা;
---হিন্দু মনীষা জেগেছে এখানে আদিম উষার ক্ষণে,
ইন্দ্রদু্যম্নে উজ্জয়িনীতে মথুরা বৃন্দাবনে!
পাটলীপুত্র শ্রাবস্ত্মী কাশী কোলশ তক্ষশীলা
অজন্ত্মা আর নালন্দা তার রটিছে কীর্তিলীলা!
---ভারতী কমলাসীনা
কালের বুকেতে বাজায় তাহার নবপ্রতিভার বীণা!

এই ভারতের তখতে চড়িয়া শাহানশাহার দল
স্বপ্নের মণি-প্রদীপে গিয়েছে উজলি আকাশতল!
---গিয়েছে তাহারা কল্পলোকের মুক্তার মালা গাঁথি,
পরশে তাদের জেগেছে আরব্য-উপন্যাসের রাতি!
যমুনাজলের পুরানো বাঁশিতে বেজেছে নবীন সুর!
নতুন প্রেমের রাগে
তাজমহলের তরুণিমা আজো ঊষার অরুণে জাগে!

জেগেছে হেথায় আকবরী আইন,---কালের নিকষ কোলে
বারবার যার উজল সোনার পরশ উঠিছে জ্বলে!
সেলিম,--শাজাহাঁ,--চোখের জলেতে একশা করিয়া তারা
গড়েছে মিনার মহলা স্ত্মম্ভ কবর ও শাহদারা!
---ছড়ায়ে রয়েছে মোগল ভারত,---কোটি সমাধির স্তূপ
তাকায়ে রূেছে তন্দ্রাবিহীন,--অপলক অপরূপ|
--যেন মায়াবীর তুড়ি
স্বপনের ঘোরে স্ত্মব্ধ করিয়া রেখেছে কনকপুরী!

মোতিমহলের অযুত রাত্রি,--লকজ্ষ দীপের ভাতি
আজিও বুকের মেহেরাবে যেন জ্বালায়ে যেতেছে বাতি!
---আজিও অযুত বেগম-বাঁদীর শষ্পশয্যা ঘিরে
অতীত রাতের চঞ্চল চোখ চকিতে যেতেছে ফিরে!
দিকে দিকে আজো বেজে ওঠে কোন গজলঢ়ইলাহী গান!
পথ-হারা কোন ফকিরের তানে কেঁদে ওঠে সারা প্রাণ!
--নিখিল ভারতময়
মুসলমানের স্বপন-প্রেমের গরিমা জাগিয়া রয়!

এসেছিল যারা উষর মরুগিরিপথ বেয়ে,
একদা যাদের শিবিরে-সৈন্যে ভারত গেছিল ছেয়ে,
আজিকে তাহারা পড়শি মোদের, --মোদের বহিন-ভাই;
---আমাদের বুকে বক্স তাদের,---আমাদের কোলে ঠাঁই|
‘কাফের ‘যবন টুটিয়া গিয়াছে,---ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা,
মোসলেম বিনা ভারত বিফল,--বিফল হিন্দু বিনা;
---মহামৈত্রীর গান
বাজিছে আকাশে নব ভারতে গরিমায় গরীয়াস!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

The text publised in this blog is written by Jibanananda Das. Jibanananda Das (Bengali: জীবনানন্দ দাশ, /dʒɪbɒnʌnɒndɔː dʌʃ/) (17 February 1899 – 22 October 1954) was a Bengali poet, writer, novelist and essayist. Due to copyright law of Bangladesh and India His works are available under public domain from 2014 after 60 years of his death. Me being an admirer of his work, took the liberty to type and publish this text online. This text is not proof read and not complete. In case of any dispute please contact me snewaj at gmail dot com.